সফলতার অন্তরালে
অনেকে আমার জীবনকে মোটামুটি সফল বলে ভুল করেন। অনেকেই আবার আমার এই আপাতসাফল্যের রহস্য অথবা এর পেছনের মানুষদের কথা জানতে চান। আমার আজকের লেখা আমার সফলতা বা বিফলতা নিয়ে না, বরং যেসব মানুষ আমার জীবনে নিঃশব্দে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের নিয়ে।
অনেকের অবাক লাগলেও আমার কাছে মনে হয় তাদের অবদান আকাশসম। আমার জীবনকে সহজ করে তোলার জন্য তাদের পরিশ্রম অক্লান্ত। তাদের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য।
তারা কারা?
তারা হলেন আমার বাসায় বিভিন্ন সময়ে অর্থের বিনিময়ে যারা শ্রম দিয়েছেন। আমি তাদেরকে সাধারণত আমার হোম ম্যানেজার বলেই পরিচয় করাই। সারাদিন অফিস শেষে ক্লান্ত আমি বাড়ি ফিরে ছোট বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই যখন ঘুমে ঢোলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম করতাম, তখন যারা আমার কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে গিয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমাকে একটু বেশি সময় ঘুমানোর সুযোগ দিত, তাদের কথা।
যখন বাচ্চা ঘরে রেখে ট্যুরে গেছি দেশে-বিদেশে, তখন তো ফী সাবিলিল্লাহ! মাত্র কদিন আগে ছোট ছেলের জন্ডিস। আমার বিদেশ যাওয়ার সব ঠিকঠাক। দুদিন পরে ফ্লাইট, হঠাৎ করেই ছেলের জন্ডিস ধরা পড়লো। এক সপ্তাহ যাওয়া পিছালাম কিন্তু আর কত! অগত্যা সেই হোম ম্যানেজারের হাতে ছেলেকে সোপর্দ করে উড়াল দিলাম। বিদেশি কলিগদের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে যখন কথা উঠলো বাচ্চার অসুখ নিয়ে, সহানুভূতিশীল হয়ে অনেকে প্রশ্ন করলেন, তোমার বাচ্চা কতটুকু? তখন খুব কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে উত্তর দিলাম, এইতো একুশ-বাইশ। আসলে চট করে বয়স দু’বছর কমিয়ে বলেছি। তারপরও দেখি বিস্ময়ে দুচোখ কপালে তুলেছে, তাতে অবশ্য আমার করার কিছু নাই!
যাহোক ফিরে আসি আবার হোম ম্যানেজারের প্রসঙ্গে। বাড়ি ফিরে টেবিলে তৈরি খাবার, ইস্তিরি করা কাপড় – বিশেষ করে সকালের তাড়াহুড়োয় ঘন দুধের গরম এককাপ কড়া চায়ের মূল্য কি শুধু টাকায় পাওয়া যায়?
আরো আছে! আমি কী খেতে পছন্দ করি, সেটা নিশ্চিতভাবে আমার ছেলেরা জানে না। কিন্তু আমার সেই পছন্দের খাবার তারাই রান্না করে, যত্ন করে ফ্রিজে তুলে রেখে খাওয়ায়। মা-বাবাহীন মানুষের জন্য এটা একটা বিশাল পাওয়া!
মাঝেমধ্যে একটা কথা আমি প্রায়ই বলি। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ঝামেলা এককাঠি বাড়া। ছেলেদের তো কেবল একটা নীল, সাদা বা কালো একরঙা বা চেক শার্ট গায়ে চাপালেই হয়। আর মেয়েদের? শাড়ির সাথে মিলিয়ে ব্লাউস-পেটিকোট, জুতো-ব্যাগ আর হালকা গয়না-সাজগোজ সবগুলোই অপরিহার্য। আর শেষ মুহূর্তে শাড়ির কুঁচি ঠিক করা কি যে দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার! এসবের জন্য সকালের মূল্যবান সময় ম্যানেজ করা ছোটখাটো যুদ্ধজয়ের মতই।
আমার হোম ম্যানেজারের ভাগ্য সব সময় নিতান্তই ভালো। সকালে উঠে কী পরে যাব না যাব, সেই দায়িত্ব আর সিদ্ধান্ত – দুটোই তার। শাড়ির সাথে ম্যাচিং গয়না কিংবা জুতো, সবটাই তার পছন্দের উপর।
তবে মাঝে মধ্যে এ নিয়ে যে খেসারত দিতে হয় না, তা না। গত বছর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এর পোস্ট ডিপ্লোমা করার জন্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি-তে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রথম দিন ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্য রেডি হবার সময় সে কোত্থেকে যেন বিশালাকৃতির এক জোড়া কানের রিং নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল: এইডা পরেন, সিনেমার ভিতরে মাইয়ারা এইরকম রিং পইরা ইনভার্সিটিতে যায়। আমি কথা না বাড়িয়ে, রিং দুটো পরে ফেললাম।
আমাকে হরহামেশাই এ ধরনের নানা রকম লাইভ এন্টারটেইনমেন্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়!
আজকাল সে আবার ইউটিউবের রান্না আর অনলাইন গ্রোসারি শপিং-এর দিকে ঝুঁকেছে। যখন-তখন আবদার ধরে মোবাইল দিয়ে জিনিস কিনে দেয়ার। সম্ভবত নগদে পেমেন্ট করে জিনিস রিসিভ করার মধ্যে তার একরকম এম্পাওয়ামেন্ট কাজ করে।
সেদিন বাসায় মুরগি নাই । ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনলাইনে একটা টার্কি অর্ডার দিয়ে নিশ্চিন্তে অফিসের পথে পা বাড়ালাম। বাকিটা সামাল দেয়ার দায়িত্ব তার। দুপুরনাগাদ মিটিং-এ বসেই পেলাম হোম ম্যানেজারের ফোন। মিটিং-এর মধ্যে ধরার সাহস পেলাম না। যদি আবার জিজ্ঞেস করে: মামি, আলু গুল কইরা কাটমু নাকি লাম্বা? কিছুক্ষণ পরে আবারও তার ফোন। জরুরি ভেবে সন্তর্পণে ফোন ধরতেই তার উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো: মামি, বিরাট একটা মুরগি আনছে! কথা না বাড়ায়ে ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রাখলাম। কিছুক্ষণ পরে আবারও তার ফোন। এবার আর ধরলাম না। এরপর ফোন আসলো ড্রাইভারের মোবাইল থেকে। ঘটনা কী বুঝতে অবশেষে রুম থেকে বের হয়ে ফোন ধরতেই উত্তেজিত গলা শুনতে পেলাম: আপা, মুরগি তো ডিম দিছে!
Masudur Rahman
Really grateful to them who makes our life easy like your home managers…