হাসিন জাহান
ঢাকা, বাংলাদেশ

আমি হাসিন। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছেছি জীবনের প্রায় মাঝ বরাবর। পথ চলতে চলতে অনেক কিছু দেখা হয়েছে, জানা হয়েছে, শেখা হয়েছে। অনেক সময় চোখের দেখার বাইরেও অনেক বিষয় অনুধাবন করেছি ভিন্নভাবে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই বোধহয় এক একটা উপন্যাস। আমার জীবনের উপন্যাসের পাতাগুলো থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে ডিজিটাল স্মৃতির খাতায় জমা রাখার জন্য এই ব্লগ। আর তাতে যদি কারো ভালো লাগে, সেটা হবে বাড়তি পাওনা। একটাই জীবন, তাই এর প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠুক আনন্দময় আর আলোকিত!

খোঁজ করুন
খোঁজ করুন
আপন ভাবনা

সংসার বনাম চাকরি

on
December 26, 2018

আমার খুব নিজেস্ব একটা ধারণা হলো- আমাদের শহুরে জীবনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজেই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স সবচেয়ে বেশি, এবং তার বেশির ভাগই হয় অভিনব কায়দায়। এর সপক্ষে আমার কোনো রিসার্চ বা স্ট্যাটিসটিক্স নেই। এটা শুধুই আমার একান্ত ভাবনা।
কেন জানি খুব সহজেই বিভিন্ন বয়সের, শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষের সাথে আমার এক ধরনের সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনেকেই তাদের না-বলা কথা আমাকে বলেন। সেসব না-বলা কথার সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকেই আমার এই ধারণার জন্ম।

মেয়েদের জন্য খুব টানাপোড়েনের একটা বড় ক্ষেত্র সংসার বনাম চাকরি। দুইয়ের সমন্বয় করতে অনেকেরই ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা হয়। আজকাল মেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে তবেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চান। চাকরিতে থিতু হয়ে সমসাময়িক সহকর্মীদের পাশে যোগ্যতার মাপকাঠিতে নিজেকে দাঁড় করানোর ‘পুলসিরাত’ পার হবার ক্রান্তিকালেই আরেক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। তা হলো- সময়ের দাবিতে আপনি মা হবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত নেয়া। তবে মা হওয়া মাত্রই আপনি কীভাবে সন্তান-সংসার সামাল দেবেন সেই দ্বায়িত্বও কিন্তু আপনার!

কদিন আগে এক মেয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। মেয়েটির প্রফেশনাল ক্যারিয়ার যথেষ্ঠ উজ্জ্বল। সুখী দম্পতির দুজনেই ক্যারিয়ার-সচেতন। কিন্তু দুজনের পরিবার থেকেই তীব্র চাপ- সন্তান না হলে জীবনটাই বৃথা এবং এখনই উপযুক্ত সময়! আত্মীয়স্বজনেরা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আজকাল তাদেরকে সরাসরি এমন ধরনের প্রশ্ন করা শুরু করেছেন যে দম্পতিটি এখন পারিবারিক জনসংযোগ এড়িয়ে চলতে মোটামুটি বাধ্য হচ্ছেন।
গুরুগম্ভীর আলোচনার এই পর্যায়ে আমার একটা লঘু প্রবাদ মনে পড়ে গেল – যার বিয়ে তার খোঁজ নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই।

হতে পারে- আপনার শারীরিক আর মানসিক সামর্থ্য একই সাথে চাকরি এবং সন্তানকে সামলে চলার জন্য প্রস্তুত না! সেক্ষেত্রে আপনাকে হয়তো যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হতে পারে! তবে আপনি যাই করেন নিশ্চিত থাকেন যে চাকরি না করলে আপনাকে যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তা হলো: কাজ তো করো না, সারাদিন বাসায় কী করো?
আর আপনি যদি চাকরি করেন তবে বাসায় ফিরে আপনাকে শুনতে হবে: সারাদিন চাকরি কর, বাসার কী কর?
অথচ আপনি হয়তো নিজের জন্য প্রয়োজনীয় ঘুম, বিশ্রাম, এমনকি খাওয়ার সময়টাকেও ছোট করে সেটা ব্যয় করেছেন সন্তানের যত্নে বা কর্মক্ষেত্রের বাড়তি চাপ সামলাতে! অথচ পরির্বতে শুনবেন যে আপনার গাফিলতির কারণে সন্তানের স্বাস্থ্যহানি হয়েছে কিংবা ঘড়ি ধরে বাসায় ফেরার কারণে সমালোচিত হয়েছেন সহকর্মীমহলে।

অনেক মেয়ের ক্ষেত্রেই সন্তান জন্মের পরে চাকরির যবনিকা পড়েছে। আগ্রহ এবং যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকে বিদেশে ট্রেনিং/পড়া অথবা চ্যালেঞ্জিং এসাইনমেন্ট নেয়ার সুযোগ থেকে নীরবে সরে দাঁড়িয়েছেন। যারা অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে সমান তালে এগুতে চাচ্ছেন, অনেক সময় তাদেরকে পরিবার থেকে বলা হয় উচ্চাভিলাষী, সংসারের প্রতি উদাসীন এবং কখনো কখনো বাদানুবাদ তো সেই মেয়ের চরিত্রে গিয়ে ঠেকে!
বেশ কিছুদিন আগে বিদেশ সফরে যাবার আগে ছলছল চোখে এক মেয়ে আমাকে জানালো প্রতিবার তার ট্যুরে যাবার পূর্বাপর বিড়ম্বনা। শুনে আমি হেসে বললাম: একই পুলসিরাত আমিও পার হয়েছি। সময়ই অনেক কিছুর সমাধান দেয়। হাল ছেড়ে দেয়া কোনো সমাধান না। কদিন পরে ফিরে এসে জানালো: এবারে তার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। বলার ধরনে বুঝলাম, সে এখন আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী। প্রতিশ্রুতিময় অনেক মেয়েকেই দেখেছি তাদের এই নিরন্তর যুদ্ধের কথা তারা নিজের মা-বাবাকেও জানান না, পাছে তারা কষ্ট পান। অনেক সম্ভাবনা নিয়ে- ঝিনুক নীরবে সহে!

কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের পদচারণা যত বাড়ছে, ভিন্নধারার কিছু অনুসঙ্গও তত যোগ হচ্ছে। একসময় ধারণা করা হতো মেয়েদের চাকরি করা মানে বাড়তি আয় এবং সেটা যেন শুধুই তার শখ পূরণের নিমিত্তে! সংসারে অপরিহার্য নয়! তবে এখন অনেক পরিবারেই দেখা যায় যে স্ত্রীর আয়েই সংসার খরচের সিংহভাগ চলে। কিন্তু সেসব পরিবারেও খুব সূক্ষ্মভাবে সকাল-বিকাল সেই মেয়েকে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে- তাকে চাকরি করতে দেয়া হয়েছে আর তার আয় যে পরিবার গ্রহণ করছে সেটাই মুখ্য বাকি সবই গৌণ।
তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। আমার এক ভাইয়ের স্ত্রী প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক মাপকাঠিতে উনার চাইতেও যথেষ্ঠ ভালো অবস্থানে আছেন। দুজনের বোঝাপড়া অনুকরণীয়। সেদিন এ প্রসঙ্গে বেশ মজা করে বললেন: আমি তোমার ভাবিকে শুধু মানুষ হিসেবে প্রাপ্য তার যোগ্য সম্মানটুকুই দেই। বিনিময়ে তার অর্থ, সম্পদ, আর সে- সবটুকুই তো আমার আর আমাদের পরিবারের। কথায় দম আছে! যেকোনো মেয়েরই প্রায়োরিটি তার ফ্যামিলি। সে তার জীবনের সমস্ত পুঁজি তার পরিবারের পিছনে বিনিয়োগ করে। বিনিময়ে হয়তো চায় প্রাপ্য সম্মান। ছেলেরা সম্ভবত সেটাই দিতে কার্পণ্য করে।

চাকরি করা মায়েদের মনে সবসময় একধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। সেই নির্দোষ অপরাধবোধ থেকেই দেখেছি অনেক মা অফিস থেকে ফেরার সময় সন্তানের জন্য চকলেট নিয়ে বাসায় ফেরেন। ফলশ্রুতিতে একটা সময় সেই সন্তান শুধু চকলেটের জন্য অপেক্ষা করে। হয়তো মায়ের জন্য না!
আমি নিজেও সেই একই অপরাধবোধে কাটিয়েছি বছরের পর বছর। এখন প্রায়ই মনে হয়- আমার সন্তানদের ছোট বেলায় স্কুল আনা-নেয়া করতে যাইনি, ভাত মেখে খাওয়ানোর জন্য সারাবাড়ি ছোটাছুটি করিনি, হোম ওয়ার্ক করানোর জন্য প্রাণপাত করিনি, পরীক্ষায় বেশি নম্বরে পায়নি বলে হা-হুতাশ করিনি, দিন শেষে চকলেট নিয়ে ঘরে ফিরি নাই- আমি কী আসলে মা হতে পেরেছি! আমার ছোট ছেলে আমাকে সান্ত্বনা দেয়: তুমি যতটুকু সময় দিয়েছ অতটুকুই ভালো ছিল, এরচেয়ে বেশি দিলে এনোয়িং হতো!

ফেইসবুক কমেন্ট - Facebook Comments
TAGS
4 Comments
  1. Reply

    Md.Masum Hossain

    December 27, 2018

    অসাধারন!
    আমার জীবনেরই চিত্র।
    আমি আর সে চাকুরী করি।
    ফ্যামিলির লোকেরা বলে, ঘরে বাইরে দুইজন চাকুরী কর, টাকা কি কর? মনে হয় শ্বশুর বাড়ি জমায়।
    বন্ধু বান্ধব বলে, শালারা এখন আর চিনেনা, শুক্রবার ও কি সময় পায়না?
    আত্মীয় পরিজন বলে, বিয়ের পর ও চেইঞ্জ হয়ে গেছে, দুইজন চাকুরী করে, এখন আর আমাদের লাগেনা, অথচ ছাত্র জীবনে কত ভাল ছিল, এখন বউয়ের পরামর্শে চলে।
    সমাজ বলে, ভালোই, দুইজন চাকুরী করে এত টাকা খায় কে? মনে হয় লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা আছে। দান খয়রাত করলে কি আর সম্পদ কমে?

  2. Reply

    hasin

    December 30, 2018

    আপনি অত্যন্ত চমৎকার করে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরেছেন!

  3. Reply

    Monjur Ahmed

    January 3, 2019

    নারীর ওপর কোন কিছু চাপিয়ে দেয়াটা আরেক সমস্যা। আমি এমন অনেক নারীকেও দেখেছি যাদের ইচ্ছে চাকরি ছেড়ে কিছুকাল সন্তান বা ঘরকন্নায় আরও সময় দিতে চান, কিন্তু পরিবার বা সমাজের প্রত্যাশার চাপে সেটা সম্ভব হচ্ছেনা। “এতো পড়াশোনা করে ঘরে বসে আছে কেন” – এই অনর্থক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।গৃহস্থালি কাজে নারীর মেধা ও শ্রমের মূল্যায়ন থেকে অনেক দূরে আছে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি মানসিকতা। কারও হয়তো আরও পড়াশোনা করারও ইচ্ছে। নারীকে সেই স্বাধীন ও সন্মানজনক পরিবেশ দেয়াও দরকার যেখানে সে সাচ্ছন্দে নিজের চাওয়া পাওয়া নিয়ে জীবন সাজাতে পারে।

  4. Reply

    হাসিন জাহান

    January 7, 2019

    ঠিকই বলেছেন!

Leave a Reply to hasin / Cancel Reply