হাসিন জাহান
ঢাকা, বাংলাদেশ

আমি হাসিন। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছেছি জীবনের প্রায় মাঝ বরাবর। পথ চলতে চলতে অনেক কিছু দেখা হয়েছে, জানা হয়েছে, শেখা হয়েছে। অনেক সময় চোখের দেখার বাইরেও অনেক বিষয় অনুধাবন করেছি ভিন্নভাবে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই বোধহয় এক একটা উপন্যাস। আমার জীবনের উপন্যাসের পাতাগুলো থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে ডিজিটাল স্মৃতির খাতায় জমা রাখার জন্য এই ব্লগ। আর তাতে যদি কারো ভালো লাগে, সেটা হবে বাড়তি পাওনা। একটাই জীবন, তাই এর প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠুক আনন্দময় আর আলোকিত!

খোঁজ করুন
খোঁজ করুন
জীবন যেখানে যেমন

বড় স্যারের ছোট গল্প ১

on
November 1, 2018

কিংবদন্তির নায়ক কামরুল ইসলাম সিদ্দিক স্যারকে নিয়ে জানা-অজানা অনেক গল্প আছে। দীর্ঘ চার বছর এলজিইডিতে কাজ করার সুবাদে আমি এর অনেক কিছুর অংশ হয়েছিলাম।
আমরা সবাই উনাকে ‘বড় স্যার’ বলে সম্বোধন করতাম। তখন বিষয়টা মাথায় আসেনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কেন উনাকে বড় স্যার বলে ডাকতাম? ছোট স্যার বলে তো কেউ ছিল না! তবে উত্তরটা আমার জানা নেই।

যারা সেই আমলে এলজিইডির ঢাকা অফিসে কাজ করেছেন, তাদের ‘ডেইলি রিপোর্ট’ অথবা ‘স্টপ স্যালারি’-র অভিজ্ঞতা হয়নি – এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। যারা উনার সাথে সরাসরি কাজ করেননি, তাদের জন্য ব্যাপারটা একটু খুলে বলি।

উনার সামনে পড়লে সবাই কমবেশি প্রমাদ গুণতেন। চলাফেরার পথে কেউ যদি উনার নজরে পড়তেন, যার কাজ সম্পর্কে উনি পুরোপুরি ওয়াকিবহাল না, অমনি ধরা! দেখার সাথে সাথেই বলতেন, ‘তুমি কি করতেছ? আমাকে এখন থেকে ডেইলি রিপোর্ট দিবে।’
আর যায় কোথায়! যিনি সামনে পড়ছিলেন তার অন্তত মাস-খানেকের শাস্তি। রোজ সন্ধ্যায় ফাইলে পাঞ্চ করে ডেইলি রিপোর্ট উনার রুমের বাইরে জমা দিয়ে যেতে হতো। যার বরাতে এই রিপোর্ট জমা দেয়ার নির্দেশ জারি হতো, তার প্রথম কাজ হতো: প্রতিদিন সকালে একটা যুতসই কাজ খুঁজে বের করে বিকেল নাগাদ সেই কাজের আপডেট দরখাস্তের আদলে হাতে-লিখে ফাইলবন্দী করে বড় স্যারের দরজার বাইরে রেখে যাওয়া।
পরদিন এগারোটা নাগাদ সেই রিপোর্ট স্যারের হাত ঘুরে ঠিক নিজের টেবিলে চলে আসতো। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এতো কষ্টে বারকয়েকের চেষ্টায় হাতে-লেখা রিপোর্টে শত-সতর্কতা সত্ত্বেও দেখা যেতো যে, ঠিক যেখানটায় বানান কিংবা গ্রামারটা ভুল করেছেন, সেখানটাতেই একটা বিশাল গোল্লা। মাঝে-মধ্যেই ‘ধরণী দ্বিধা হও’ টাইপের হৃদয়বিদারক কমেন্ট।

পর্দার অন্য পাশে তখন আরেক দৃশ্য। সারাদিন কাজ শেষে বারান্দায় অথবা বিশাল ড্রইং রুমের সোফায় বসে নিবিষ্টচিত্তে ফাইলে চোখ বুলাচ্ছেন সৌম্যমুর্তির সেই মানুষটি। পায়ের কাছে ফাইলের স্তুপ। প্রতিটি ফাইলে তার দৃষ্টি স্থায়ী হয় মাত্র কয়েক মূহুর্তের জন্য। পরক্ষণেই কালির আঁচড়। ব্যস, একের পরে এক ফাইল দেখা চলে ক্লান্তিহীনভাবে। আগের লেখায় বলেছিলাম উনি ‘ডায়াগনাল রিডার।’ এত দ্রুত পড়তে আমি কাউকে দেখিনি!

এর পরের গল্প ‘স্টপ স্যালারি!’ স্যার যার উপরেই কাজ নিয়ে চটতেন, তার ডেইলি রিপোর্টের উপর লাল কালির লেখা পড়তো stop salary। এই বিড়ম্বনা মারাত্মক।
একবার স্টপ স্যালারির কবলে পড়লে তার খবর আছে। সাধারণত যারা পুরোদস্তুর সরকারি বেতনভোগী ছিলেন, আইনগতভাবে হয়তো তার বেতন বন্ধ হবার কথা না। কিন্তু উনার নির্দেশ অনুযায়ী তাদেরও কেন জানি বেতন হতো না।

যাহোক একবার এক সহকর্মী স্টপ স্যালারির কবলে পড়লেন। একে একে প্রায় তিন মাস! কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ভাগ্যক্রমে তার স্ত্রী ডাক্তার। কিন্তু খুব বেশি সিনিয়র না হওয়ায় চাকরি, প্রাইভেট-প্রাক্টিস মিলিয়েও সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা। তিনি মনোযোগ দিয়ে নিজের দায়িত্বের বাইরেও বাড়তি কাজ করে গুটিগুটি হাতের লেখায় প্রতিদিন ডেইলি রিপোর্ট লেখেন। কিন্তু স্যারের মন গলে না। একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে আমরা সবাই তাকে জানি। কিন্তু তারপরেও তার বেতন চালু করার অনুরোধ জানানোর দুঃসাহস করতে কেউ রাজি না।

একদিন সিনেমার ব্যর্থ নায়কের মতো উসকোখুসকো চুল আর ইস্ত্রিহীন শার্ট গায়ে আমার সামনে এসে বললেন, ‘বউয়ের উপার্জনে আর কতদিন চলি! বাসায় তো আর ইজ্জত থাকে না। যা থাকে কপালে, আজ আমি স্যারের কাছে গিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করবো।’

আমি তখন স্যারের স্টাফ অফিসার। এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াও কাউকে উনার কাছে যেতে দেয়ার বিশাল ক্ষমতা আমার হাতে! আমার ইশারা পেতেই উনি রুমে ঢুকে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমি অতি আগ্রহে আমার সিট থেকেই লক্ষ্য করতে থাকলাম।

ওমা! ‘হেস্তনেস্ত’ করতে এসে দেখি তিনি মূর্তিমান পাথরের রূপধারণ করছেন! একটা কথাও দেখি তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না! কয়েক সেকেন্ড পরে স্যার ফাইল থেকে চোখ তুলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকে কী যেন বললেন। তারপরে যথারীতি ফাইলে মনোযোগ দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি রুম থেকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বের হয়ে আমার টেবিলের সামনে এসে বললেন: হাসিন, আমার তো প্রমোশন হইছে!
আমি এখন সোজা বাসায় যাবো। আপনার ভাবিকে বলতে হবে। আকর্ণবিস্তৃত হাসির সাথে তখন তার চোখের কোনায় একফোঁটা পানি চিকচিক করছে।

ফেইসবুক কমেন্ট - Facebook Comments
TAGS
9 Comments
  1. Reply

    Shaila Shahid

    November 1, 2018

    সত্যি আমি আপনার বঙ্গ লেখনীর ভক্ত হয়ে উঠছি আপা…শায়লা

  2. Reply

    Zaman shahin

    November 3, 2018

    আপা, শুভকামনা রইলো , অনেক ভালো লেগেছে আপনার লেখনিটা,।

    • Reply

      হাসিন জাহান

      November 4, 2018

      অনেক ধন্যবাদ

  3. Reply

    Riadh

    November 4, 2018

    আপা,অনেক শুভকামনা , বেশ ভালো লেগেছে আপনার লেখা।

    • Reply

      হাসিন জাহান

      November 4, 2018

      ধন্যবাদ!

  4. Reply

    Dr Jafar Ahmad Hakim

    November 4, 2018

    Excellent hard working Engineering personality. We knew him since long time. May Allah grant him Jannat.

    • Reply

      হাসিন জাহান

      November 4, 2018

      Ameen

  5. Reply

    Dr Jafar Ahmad Hakim

    November 4, 2018

    Excellent hard working Engineering personality. We knew him since long time. May Allah grant him Jannat. From: Dr Jafar Ahmad Hakim
    Former Director MCH DGFP

  6. Reply

    Mukta

    November 5, 2018

    অনেক ধন্যবাদ

Leave a Reply to Dr Jafar Ahmad Hakim / Cancel Reply