বয়স হওয়ার এগারোটি লক্ষণ
বয়স নিয়ে আলোচনা করা, বয়স্করা পছন্দ করেন না। কিন্তু কী আর করা! প্রায়ই আমাকে এ নিয়ে নানারকম বিপত্তি পোহাতে হয়। আমি যতই নিজেকে বয়সে তরুণ বলে মনে করি না কেন, চারপাশের মানুষজন আমাকে আমার বয়স মনে করিয়ে দিয়ে একটা ‘স্যাডিস্ট আনন্দ’ পাওয়ার সুযোগ ছাড়ে না। এমনকি আমার ছোট ছেলে ছোটবেলা থেকেই আমাকে অনেক বড় (পড়ুন বুড়ি) মনে করতো। আমি যে অতটা বুড়ি নই, সেটা সে প্রথম আবিষ্কার করে, যখন আমার বড় ছেলের কনভোকেশন-এর সময় তার বন্ধু-বান্ধবদের মায়েদের সাথে ওর দেখা হয়।
আসুন এবার জেনে নেই, আমার বয়স হওয়ার এগারোটি লক্ষণ –
১. আমি যখন আব্বাসের খাসির দোকানে অথবা চই ঝালে গিয়ে কেবল দুই পিস সাবড়ে দিয়ে তৃতীয়টি নেয়ার জন্য ইতি-উতি তাকাচ্ছি, অমনি আমার পাশ থেকে একজন আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন: আপা, আপনার প্রেশারটা আজকাল কেমন থাকছে? গা টা জ্বালা করলেও হাসি হাসি মুখে প্রসঙ্গ বদলাই, বলি: ওয়েটারকে এদিকটায় গামলাটা নিয়ে একটু আসতে বলেন, ভাল দেখে আরেকটা টুকরো বেছে নেই!
২. রাস্তা পার হচ্ছি, সাথে ছেলে। গাড়ি আসছে দেখে সচকিত হয়ে বাচ্চার হাত ধরার জন্য নিজের হাতটা কেবল বাড়িয়েছি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি, শক্ত একটা হাত আমার হাত খপ করে ধরে ফেলল। তারপর কড়া স্বরে ছেলে বললো, দেখেশুনে রাস্তা পার হও, গাড়ি চাপা পড়বে তো। মোটামুটি অপরাধীর ভঙ্গিতে তখন নির্দেশিত পথে রাস্তা পার হতে হয়, সাবধানের মার নাই!
৩. আগে বিদেশ থেকে উপহার আসতো চকলেট, কসমেটিকস অথবা জুয়েলারি। সম্প্রতি উপহার পেলাম প্রেসার মাপার যন্ত্র। আপা, এইটা খুব হালকা, আপনি সাথে করে ট্যুরেও নিয়ে পারবেন, আর এটা দিয়ে নিজের প্রেসার নিজেই মাপা যায়। শুনে আমার আর বলা হলো না যে, আমার এখনও হাইপার-টেনশন হয়নি। কিছুদিন বাদে উপহার পেলাম ঢাউস সাইজের এক বোতল, না, পারফিউম না, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটের।
৪. গেল বছর কুয়েটে গেলাম গেস্ট লেকচারার হিসেবে একটা সেশন নেওয়ার জন্য। উৎফুল্লচিত্তে দুজন শিক্ষক মোটামুটি এসকর্ট করে আমাকে মূল ভবনের দিকে নিয়ে যেতে থাকলেন। দুজনেই বুয়েটে পড়াশোনা করেছেন। যেতে যেতেই আমার পাশের বছর জানতে চাইলেন। অনিচ্ছসত্ত্বেও বললাম। শুনে উনাদের একজন বললেন, আপা, এই বয়সেও আপনি যে কীভাবে এত ছোটাছুটি করেন! আজকে যমুনার চরে তো, কালকে কক্সবাজারে! আমি সরু চোখে তার দিকে তাকাতে না তাকাতেই আরেকজন আবিষ্কারের উত্তেজনায় জানালেন, ‘আপনি যখন বুয়েটে ঢুকেছেন আমি তখন সবেমাত্র ক্লাস টু তে পড়ি!’ নাহ, এদের নিয়ে আর পারা গেল না!
৫. কিছুদিন আগে এক সহকর্মীর বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছি। বরবেশী সহকর্মী ঘুরে ঘুরে তদারকি করছে। আমাকে দেখতেই সে তাড়াতাড়ি আমার দিকে এগুতে থাকলো। লক্ষ্য করলাম, আরেক ভদ্রলোক প্রায় দ্বিগুণগতিতে আমার দিকে ছুটে আসছেন। দুজনে মুখোমুখি! আমার সহকর্মী আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে: হাসিন আপা, আমাদের বস আর আপা, উনি আমার শ্বশুর। শ্বশুর মশাই বেশ তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, উনি আমার অনেকদিনের আপা, তাছাড়া আমরা একই ইউনিভার্সিটির। এই কথোপকথনের মাঝেই নববধূর আগমন – আসসালামু আলাইকুম, আন্টি!
৬. বয়সে ছোট আর লম্বায় খাটো এই দুই ক্যাটাগরিতে জীবনের একটা লম্বা সময় গাড়ীর পিছনের সিটে বসেছি। তবে এখন আর কেউ গাড়িতে উঠলে পিছনের সিটে জোর করে ঠেলে দেয় না।
৭. দুধ-চিনি দেয়া ঘন চা-এ টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে মসমস করে খাবার পায়তারা করেছি। অমনি শুনি, আপা, চিনি দিয়ে চা খাচ্ছেন? এখনো ডায়াবেটিস ধরা পড়েনি? কড়া চোখে তাকাতে গিয়েও থেমে যাই! যাক, এ যাত্রা মাফ করে দিলাম। চা টা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে!
৮. নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে আলাপের কিছুক্ষণের পরেই শুনতে পাই: আপা, আমি আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট। আমাকে তুমি করে বলেন। আমি ভদ্রতা করে বলি: কি যে বলেন! কিন্তু না, উনি নাছোড়বান্দা, না আপা, তুমি করে বলতেই হবে। কি মুশকিল, এত বড় মানুষকে যদি তুমি করে বলি তাহলে আমার বয়সটা কোথায় দাঁড়ায় শুনি! অবশেষে হয়তো তুমিই বলি, কী আর করা!
৯. আমার পায়ের সমস্যা অনেকেরই জানা। মাঠে ময়দানে গেলে, প্রথম কথা আপাকে আগে ধরেন। মাঝেমধ্যে লজ্জায় মাথা কাটা যায়, আবার ভালোও লাগে!
১০. এখনকার ছেলে মেয়েদের সাথে আড্ডায় বসলে গায়ক-গায়িকা, মিউজিক ব্যান্ড, মুভি কিংবা আরবান ডিকশিনারির শব্দসম্ভার, কোনটাই কমন পড়ে না। মাঝেমধ্যে নিজেকে দলছুট, বড্ড সেকেলে মনে হয়!
১১. আগে কারো সাথে দেখা হলে মানুষ জানতে চাইতেন কাজকর্ম কেমন চলছে? আজকাল জানতে চান: শরীর কেমন আছে, আপা? কি মুশকিল! মনে মনে মহা বিরক্ত হই। শরীর কেমন আছে মানে? দেখতেই তো পাচ্ছেন সাজগোজ করে বসে আছি। শরীর খারাপ থাকার কি আছে? তারপর শুনি: আপা, আপনাকে আজকে এত পেইল লাগছে কেন? প্রেসার এর সমস্যা হচ্ছে? রাতে ঘুম হয় নাই? হালকা স্বরে জবাব দেই: সেসব কিছু না, আজকে লিপস্টিক লাগানো হয়নি।
Mazibur Rahman
এখন থেকে buet পাশের বছর টা আর কোনোভাবেই বলা যাবে না আপু।
Hasin
ঠিক বলছেন !
Paul
This is reality! Don’t worry.
Tarannum
Really enjoyed while reading. I am collecting and publishing it with the Writer’s name.
হাসিন জাহান
অবশ্যই