হাসিন জাহান
ঢাকা, বাংলাদেশ

আমি হাসিন। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছেছি জীবনের প্রায় মাঝ বরাবর। পথ চলতে চলতে অনেক কিছু দেখা হয়েছে, জানা হয়েছে, শেখা হয়েছে। অনেক সময় চোখের দেখার বাইরেও অনেক বিষয় অনুধাবন করেছি ভিন্নভাবে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই বোধহয় এক একটা উপন্যাস। আমার জীবনের উপন্যাসের পাতাগুলো থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে ডিজিটাল স্মৃতির খাতায় জমা রাখার জন্য এই ব্লগ। আর তাতে যদি কারো ভালো লাগে, সেটা হবে বাড়তি পাওনা। একটাই জীবন, তাই এর প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠুক আনন্দময় আর আলোকিত!

খোঁজ করুন
খোঁজ করুন
আপন ভাবনা

প্রথম ইন্টারভিউ প্রথম চাকরি

on
October 16, 2018

আমার জীবনে ইন্টারভিউ দেবার সুযোগ হয়েছে খুব কম। তবে যে-কটা দিয়েছি সেগুলোর প্রত্যেকটার অভিজ্ঞতাই রীতিমতো ‘ইউনিক’ । আমাদের ক্যারিয়ারের শুরুর সময়টায় এখনকার মতো ওয়েবসাইট ঘেঁটে প্রাতিষ্ঠানিক তথ্যে সমৃদ্ধ হওয়া, ইউটিউবে ইন্টারভিউ টিউটোরিয়াল দেখে প্রস্তুতি নেয়া কিংবা কিছু কমন প্রশ্নের উত্তর তৈরি করার চল তখনও শুরু হয়নি।

আমি ছিলাম খুবই ঘরকুনো প্রকৃতির। কারো সাথেপাছে নাই। আর আমার মা ছিলেন ঠিক উল্টো – খুবই মিশুক আর এককথায় ‘পাড়া বেড়ানি’। আমাদের আত্মীয়স্বজনের পরিধি এমনিতে বেশি। তাছাড়া আম্মার আতিথেয়তা-আন্তরিকতায় আমরা নিজেরাও অনেক সময় কে আত্মীয় বা কে শুধুমাত্র সল্প পরিচিত তা বুঝতাম না। তার কাছে ছিল সবার অবাধ যাতায়াত আর নিয়মিত যোগাযোগ।

তিরানব্বই সালের নভেম্বর। আমি বুয়েটের ফাইনাল শেষ করে হাওয়ায় ভাসছি, তখনও রেজাল্ট বের হয়নি। অফুরান ছুটির এক আয়েশি মূহুর্তে ল্যান্ডলাইনের ফোনে আম্মার গলা, “গাড়ি পাঠাচ্ছি এখনই চলে আস, খালু (প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক) তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন। আর সাথে তোমার মার্কশিটগুলো সাথে এনো।”

আমি তো মহা আপসেট! এখনও তো রেজাল্ট বেরুয়নি! কতো বইপড়া বাকি, আরো কতো কী করার প্ল্যান । যাইহোক, মার্কশিটগুলো বগলদাবা করে চললাম ধানমন্ডির বাসায়। তখনও চিনি না দোর্দণ্ডপ্রতাপের এই মানুষটা কে! অতএব আমি নির্ভীক। সাবলীল। স্বতঃস্ফূর্ত।

বিশাল ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি রাশভারি এক ব্যক্তিত্ব। আমি মার্কশিটগুলো হাতে তুলে দিয়ে এই অচেনা মানুষটার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করতে শুরু করলাম। তিনি খুটে খুটে মার্কশিটটা দেখতে থাকলেন। আমার ফার্স্ট ইয়ারের মাত্র পঞ্চান্ন পারসেন্ট নম্বর দেখে উনি ভ্রু কুঁচকালেন। পাতা উল্টাতেই যখন দেখলেন প্রতিবছর নম্বর ক্রমশ বাড়তির দিকে, তখন মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠলো। বললেন, “নম্বর তো বেশ ভালই পেয়েছো, তা শুরুর দিকে এত খারাপ করলে কেন?” জবাবে বললাম, “আমার ছেলে তখন খুব ছোট ছিল, অসুখ বিসুখ লেগেই থাকতো। ও একটু বড় হবার সাথে সাথে আমি ম্যানেজ করতে শিখে গেছি।” এবার বললেন, তোমার তো দেখি মেজর হিসেবে ‘স্ট্রাকচার’-ও আছে!” আবারও চোখে আনন্দের ছটা। আমি নির্ভীকভাবে বললাম, “না বুঝে এই সাবজেক্ট মেজর হিসেবে নিয়েছি। নাম্বার ভালো থাকলেও আমার পছন্দের সাবজেক্ট এনভাইরনমেন্ট। ওটা নিলে হয়তো ভালো হতো।” কথা শেষ হতে না হতেই মার্কশিটগুলো গুছিয়ে আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, “আগামীকাল থেকে অফিসে জয়েন করো।” আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “আমার তো এখনো রেজাল্ট দেয়নি। উত্তরে বললেন, রেজাল্ট কি হবে আমি জানি। তোমার মতো পরিশ্রমী আর সাহসী মেয়েরই দরকার এলজিইডি-তে।”
পরদিন সকালে লালমাটিয়ায় তিনতলায় এলজিইডি-র পুরোনো অফিসে হাজির হলাম। সারিসারি ফাইলপত্রে ঠাসা রুমের এক কোণায় আমার জন্যে টেবিল চেয়ার বরাদ্দ হলো। এক সপ্তাহ বাদে সকাল বেলায় আমার হাতে পৌঁছালো এপয়েন্টমেন্ট লেটার আর ঠিক সেইদিনই বিকেলে জানতে পারলাম আমার বুয়েটের ফাইনাল রেজাল্ট।

চাকরি করতে এসে বুঝলাম যার সাথে মাত্র কদিন আগে অবলীলায় কথা বলেছি তার সাথে কথা বলতে হলে “বুকের পাটা” লাগে! অনেক নামিদামি মানুষকেও দেখেছি তাঁর সাথে কথা বলার সময় কপালের ঘাম মুছতে। অনেক বার আমার নিজেরও শিরদাঁড়া বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরেছে।

আমার সৌভাগ্য যে এই ব্যক্তিত্বের সাথে সরাসরি কাজ করতে পেরেছি । সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখেছি তার অবিশ্বাস্য দ্রুততা আর বিচক্ষণতা। তিনি ছিলেন কঠোর অথচ কোমল। নির্ভীক। সাহসী। তাঁর পড়ার স্টাইল ছিল ডায়াগনাল। ঠিক যেখানে ভুল, নজর পড়তো ঠিক সেইখানে! আর যেকোনো কাজ করার নির্দেশ আসতো সরাসরি – Do it! Right now! ধরনের।

জীবনের প্রথম চাকরি কর্মজীবনকে অনেকটাই প্রভাবিত করে। আমাকেও করেছে। অবচেতনভাবেই তাঁর অনেক কিছু আমি ধারণ করেছি যদিও তা খুবই ছোট পরিসরে।

কাজের তাগিদে ছুটে বেড়িয়েছি সারাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায়। কিছুদিনের ভেতরেই রাস্তা নির্মাণের তদারকি করে, টাকা ছাড়, এস্টিমেট রিভিউ, ফাইলনোট লেখায় হাত পাকিয়ে নিজের অবস্থান মজবুত করে ফেললাম। কেউ আর তখন আমাকে ‘মেয়ে’ ভাবে না। ইঞ্জিনিয়ার ভাবে। আর আমি নিজেকে ভাবি ‘মানুষ’।

হঠাৎ একদিন স্যারের রুমে ডাক পড়ে। দরজা ঠেলে ঢুকতেই বললেন, “তুমি তো আবার স্ট্রাকচার পছন্দ করো না! এনভায়রনমেন্টেই তাহলে মাষ্টার্স করে আস।” এই বলে ইংল্যান্ডের একটা স্কলারশিপের কাগজ হাতে ধরিয়ে দিলেন। বিস্মিত আমি সেদিন জানতাম না যে, উনি আমার হাতে ভবিষ্যতের নতুন এক রেখা এঁকে দিলেন।

ফেইসবুক কমেন্ট - Facebook Comments
TAGS
4 Comments
  1. Reply

    Imran

    October 17, 2018

    বাবার মুখে অনেক শুনেছি স্যারের কথা কখনোই সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি কিছু না বুঝার আগেই হারিয়ে গেলেন। বাবা ও কিছুদিন আগে চলে গেছেন। হাসিন আপা খুব মিস করি বাবাকে আর বাবার মুখে শোনা সেই মহা নায়ক। আল্লাহ তাদেরকে বেহেশত নসীব করুন।

    • Reply

      হাসিন জাহান

      October 18, 2018

      আমীন!

  2. Reply

    Md Osman Goni

    October 23, 2018

    “বিস্মিত আমি সেদিন জানতাম না যে, উনি আমার হাতে ভবিষ্যতের নতুন এক রেখা এঁকে দিলেন” আর সেই রেখা দিয়েই এঁকে চলেছেন ভবিষ্যতের জন্য বসবাসযোগ্য আবাস ভূমি। আপা অসাধারণ!!

    • Reply

      হাসিন জাহান

      October 23, 2018

      অনেক ধন্যবাদ!

Leave a Reply to হাসিন জাহান / Cancel Reply