গাড়ি সমাচার
আমার নিজের গাড়ি কেনা ২০০৬ সালে। এর আগে যেখানেই চাকরি করেছি, অফিসের গাড়িতেই আসা-যাওয়া করেছি। একবার চাকরি বদলের পর ভীষণ বিপাকে পড়লাম। অফিস বনানীতে। বাসা শ্যামলীতে। এই বাজে রুটে সিএনজি-ই একমাত্র ভরসা। বাসার গাড়ি যায় ছেলেকে নিয়ে ধানমন্ডিতে, ওর স্কুলে।কোনোভাবেই ওর সাথে আমার সময় মেলানো সম্ভব হয় না। প্রতিদিন কমপক্ষে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে সিএনজিওলার মুখ ঝামটা খেয়ে তবেই একটা গতি হয়। এমন সময় এক সুবর্ণ সুযোগ এলো। আমার এক সহকর্মী চট্টগ্রামে গেছেন সস্তায় গাড়ি কিনতে। সেখান থেকে ফোন করে জানালেন- সামান্য টাকা কিছু কম পড়েছে, ধার দেয়া যায় কিনা? উনার বাসা আমার বাসার কাছাকাছি। আমি সুযোগটা লুফে নিয়ে বললাম, “অবশ্যই, তবে আমাকে যদি অফিসে আসা যাওয়ার সময় সাথে নেন!” এমনকী যাতায়াত বাবদ প্রতিমাসে তাকে কিছু টাকাও দিতে রাজি হলাম।
এরপরই শুরু হলো আসল বিড়ম্বনা। ড্রাইভার প্রতিদিন সকাল সাতটায় আমাকে তুলে নিয়ে উনার বাড়ির পার্কিং-এ এসে ঠাস করে এসি বন্ধ করে দিয়ে বলে, “স্যারে কইছে এসি বন্ধ রাখতে, তেল বেশি খরচ হইবো।” অপেক্ষার পালা শেষে দুই বাচ্চা নিয়ে উনার যাত্রা। তাদেরকে স্কুলে নামিয়ে অফিস পৌঁছুতে নয়টা ছুঁইছুঁই। দুই ঘন্টার নিশ্চিত যাত্রাও সিএনজি-চালকের মুখ ঝামটার চেয়ে উত্তম! কিন্তু সেই সুখও বেশি দিন সইল না। ক’মাসের মাথায় মাসকাবারি টাকাটা যখন উনার হাতে দিতে গেলাম, উনি জানালেন, “আপনার ভাবি বলেছেন, যদি ড্রাইভারের পুরো বেতনটাই দিতেন!” কিছু না বলে পরদিন সকালে অফিসে এসে প্রথমেই ব্যাংকলোনের ব্যবস্থা করলাম।বাকিটা অফিসের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন।লোনের আবেদন দেখে বস ধরেই নিলেন, মিথ্যে বলে লোন চাচ্ছি। ডেকে বললেন, “আপনাদেরতো গাড়ি আছে, লোন নিবেন কেন?” ঠাণ্ডা গলায় বললাম, “একটা গাড়ি থাকলে আরেকটা কেনা যাবে না, এমন কথা নেই।” কথা না বাড়িয়ে সই করলেন। বাড়ি ফিরে প্রথম কাজ হিসেবে ড্রাইভার নিয়োগ দিয়ে ফেললাম। পরদিন ড্রাইভার কাজে যোগ দিয়ে জিগেস করলো, “আপা গাড়ি কই?” আমি বললাম, “নাই! আগে গ্যারেজ ভাড়া করো।” তিন দিনের ভেতর টাকা হাতে পেয়ে চললাম শো-রুমে, সাথে বড় ভাই আর ড্রাইভার। আমার ভাবী ইতিমধ্যে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ড্রাইভারের পোষ্ট ইন্টারভিউ (রীতিমতো জেরা) নিলেন-নাম, ধাম, বংশপরিচয় ইত্যাদি। অবশেষে তিনি ঘোষণা দিলেন, “যেহেতু ঘোড়ার আগেই চাবুক কেনা হয়েছে,থুক্কু, গাড়ি কেনার আগেই ড্রাইভার রাখা হয়েছে, অতএব আজ থেকে তার নাম হবে – চাবুক।” ড্রাইভারও নতুন উপাধি পেয়ে খুশিতে আটখানা।
আমার ভাই অতি উৎসাহে নিয়ে গেলেন তার বাল্যবন্ধু, ছোটবেলা থেকে আমাদের খুব পরিচিত, তার নির্ধারিত শো-রুমে। যাতে আমি কোনোভাবেই না ঠকি। বরং কিছুটা সস্তায় গাড়িকিনতে পারি।পছন্দ হলো লাল টকটকে চমৎকার একটা গাড়ি। দাম আমার বাজেটেরচেয়ে দুলাখ বেশি। শেষমেশ এক্স-করোলাই সই।উনার মধ্যস্থতায় দরদাম শেষে গাড়ি কিনে, ড্রাইভারসহ সোজা বাসায়! কি কারণে যেন মানি রিসিটটা সেদিন নেয়া হয়নি। দু-তিন দিন পর গাড়ির মানি রিসিট আনতে গেলাম শোরুমে। মূল মালিক নেই, অফিস সহকারী বললেন, “কতটাকার মানি রিসিট দিব?” অবাক হয়ে বললাম, “কেন? যত টাকায় কিনেছি তত টাকার”।লোকটি নির্বিকারভাবে বললো, “ওই স্যার যে বিশ হাজার টাকা কমিশন লইছে, হেইডা শুদ্ধা লিখব?” বড় ধরনের ধাক্কা সামলে বললাম, “না, ইনকাম ট্যাক্সে দেখাবো, কাজেই মূল টাকাটাই লেখেন।” বিষয়টা মনের ভেতর খচখচ করতে থাকলো! বিশ্বাস জিনিসটাই সম্ভবত ভংগুর।
অতঃপর চাবুক দীর্ঘদিন তার ‘চাবুক’ পরিচয়েই আমার সাথে পরিবারের একজন সদস্য হয়ে কাজ করেছে।পরে সে এক কোম্পানিতে চাকরি নেয়। এখনও আমাদের সবার কাছে সে চাবুক হিসেবেই রয়ে গেছে। ঈদে-পরবে দেখা করতে, বা ফোন করে খোঁজ নিতে তার কখনও ভুল হয় না। প্রতি বছর নিয়ম করে আমার কাছ থেকে একটা ডায়েরি আর একটা ক্যালেন্ডার নিয়ে যেত। এ বছরের শুরুতে ফোন দিয়ে বললো, “আপা, চাকরিতে রেগুলার হইছি, আপনার জন্য একটা ক্যালেন্ডার রাখছি, কখন দিতে আসব?” অনুভব করলাম, শিক্ষা, অর্থ, সম্পদ – এসবের বাইরে মানুষের আসল পরিচয় মানবিকতায়, আন্তরিকতায়, সম্মানে, ভালবাসায়!
Selina Ferdous
Am I getting obsessed day by day! I wonder he couldn’t do that with you if you had been a male!
Hasin
Don’t know what would have happened if I were a male! I find people’s attitude and behaviours quite interesting. Will write more on my experience during different jobs someday
Mukta Khanam
Fantastic Story.
Hasin
Thanks indeed!
হাসিন জাহান
Thanks a lot!
পরাগ মাঝি
লেখাটা খুব ভালো লেগেছে।
হাসিন জাহান
অনেকধন্যবাদ!
abdul main
ata basobota…