আজ আমার জন্মদিন
আজ আমার জন্মদিন। আবার আমার বাবার মৃত্যুদিবসও। আমার বাবা যেদিন মারা যান, সেদিন আমার ঠিক বাইশ বছর বয়স। আমি রাতারাতি বড় হয়ে গেলাম। তাই এটা আমার দ্বিতীয় জন্মদিনও বটে।
আমি আমার বাবার শেষ বয়সের সন্তান। শেষ বয়সের একমাত্র কন্যাসন্তান হবার সুবাদে অতি আদর-আহ্লাদে আমি যে যথেষ্ট স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ পেয়েছি সেটা বলাই বাহুল্য। বয়সের বিশাল ব্যবধান সত্ত্বেও উনার সাথে ছিল খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। যেকোনো কথাই বলা যেত নিঃসংকোচে।
আমি উনাকে অসম্ভব রকম ভালোবাসতাম। বুঝে, না বুঝে আমি সবসময়ই আমার বাবার মতো হতে চেয়েছি। বুদ্ধি হবার পর থেকে দেখেছি উনি বাংলাদেশ বেতারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন। উনার কর্মব্যস্ততা আমাকে মুগ্ধ করতো। ভাবতাম, পৃথিবীতে বুঝি এটাই একমাত্র সম্মানজনক পেশা। ছোটবেলা থেকে তাই ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছি।
সেই আমলে কাজের ধারা ছিল ভিন্ন। তখন স্টেনোটাইপিস্ট আর পিএ-র যুগ। ডিক্টেশন আর শর্টহ্যান্ডে নোট নেয়া, এনালগ টেলিফোন ঘুরিয়ে কানেক্ট করিয়ে দেয়া, কলিং বেল, ফাইলনোট, সই-সাবুত, মিটিং – এসবে আমার অপার আকর্ষণ। উনার মতো মাল্টি-টাস্কিং করতে আমি খুব কম মানুষকেই দেখেছি। স্কুল শেষে মাঝে-মধ্যেই উনার অফিসের রুমে পিছনের সোফায় বসে পা দুলিয়ে মজাদার নাস্তা খেতে খেতে দেখতাম উনার একার কাজ সামাল দিতে দু-চার জনের দফারফা শেষ। তবে দিনশেষে কোনোকিছুই পড়ে থাকতো না পরের দিনের জন্য – ফাইল অথবা সিদ্ধান্ত! ম্যানেজমেন্টের অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই আমি পেয়েছি উনার শিক্ষানবিশ হিসেবে। সবসময় বলতেন: সবার কাছে থেকে শুনবে, কিন্তু ডিসিশন নিবে ট্রায়াংগুলেশন আর নিজের বিবেচনা থেকে, অন্যের কথায় প্রভাবিত না হয়ে। আরেকটা কথা বলতেন: কখনোই আগামীকাল আসবে না, সুতরাং আগামী কালকের জন্য কোনো কিছুই ফেলে রাখবে না। স্টাফ ম্যানেজমেন্ট আর ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্টের অনেক মূলমন্ত্রই আমার ছোটবেলায় শোনা।
আব্বা তাঁর রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান তৈরি করেছিলেন যখন উনার বয়স ছিল মাত্র চল্লিশের কোঠায়। না, সেটা কোনো কনস্যালটেন্সি ফার্ম খোলার পরিকল্পনা ছিল না। ছিল শখের হোমিওপ্যাথি। একদম স্বাধীন পেশা। শুনেছি আমার দাদার নাকি হোমিওপ্যাথিতে খুব হাতযশ ছিল। দূরদূরান্ত থেকে উনাকে দেখাতে রোগী আসতো। আমার আব্বা তাঁর বাবার পেশাকেই বেছে নিয়েছিলেন রিটায়ারমেন্টের পরের পেশা হিসেবে। তার প্রস্তুতি হিসেবে রীতিমতো চার বছর পড়াশোনা করে, পাশ করে সার্টিফিকেট পর্যন্ত ঝুলিতে ভরতে কার্পণ্য করেননি। রিটায়ারমেন্টের পরে রীতিমতো চেম্বার খুলে বসলেন। তিনটে আলমারি ভর্তি ওষুধ, দুই আলমারি বই আর সাথে ফাইল কেবিনেট। এখন ভাবতে অবাক লাগে যে, সেই আমলে একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার হিসেবে তাকে দেখছি প্রতিটি রোগীর নামে ‘ইউনিক আইডি’ সমেত আলাদা ফাইল মেইনটেইন করতে! দাদার হাতযশ দেখিনি। তবে আমার ধারণা অনুযায়ী আব্বার স্বল্পকালীন ডাক্তারি জীবনের আয়, সম্ভবত তার সরকারি চাকরি জীবনের পুরো আয়কেই ছাড়িয়ে গেছিল।
উনার অফিস জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবন-ও ছিল সবকিছু খুব গোছানো। অনেক পরিবারে দেখেছি পরিবার প্রধান মারা গেলে প্রথমেই যে সমস্যা দেখা দেয়, তা হলো কেউই জানে না টাকা বা সম্পদ কোথায় কী আছে। আব্বা অনেক আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলেন- জমিজিরাত বা ট্যাক্স ফাইল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আছে উনার আলমারির তিন ও চার নম্বর তাকে। আদতেও তাই। আমরা যে বাড়িতে থাকি, সেটার জমি কেনার জন্যে পত্রিকায় বছর ত্রিশেক আগের যে বিজ্ঞাপনটা এসেছিল সেটারও অরিজিনাল কাটিং ওই জমির ফাইলে পেয়েছি। উনার মতো চরম বাস্তববাদী মানুষ আমি কমই দেখেছি। উনার অনুপস্থিতিতে যেন টাকা নিয়ে সমস্যায় না পড়ি সেজন্য জয়েন্ট একাউন্ট খুলেছেন সেই কবে! বলে রেখেছিলেন যে- উনি বাসায় মারা গেলে সবচেয়ে আগে যেন ডাক্তার ডেকে উনার ডেথ সার্টিফিকেটটা নিয়ে নেই। পরে ওটাই সবচেয়ে কাজে দেবে।
ছোটবেলায় সাথে নিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলানো, চেক লিখতে শেখানো থেকে শুরু করে গাড়ির ফিটনেস করানো পর্যন্ত কোনো কাজ শেখানো বাকি রাখেননি। বাড়ি কন্সট্রাকশানের দেখাশোনা কিংবা থানায় জি ডি করা, বাদ যায়নি কিছুই। অবসরে বাসায় উনার ব্যক্তিগত টাইপরাইটারে ছোটখাটো টাইপের কাজ করার সুযোগও দিতেন। উনার প্রতি কৃতজ্ঞ যে উনি আমাকে একজন মানুষ হিসেবে বড় করেছেন, মেয়ে হিসেবে নয়।
মাত্র উনিশ বছর বয়সে সন্তানসহ যখন ফিরে এলাম, উনি আমাকে সমান মর্যাদায় জায়গা করে দিলেন। কিন্তু আমার হাতে সংসারের এত বড় ভার দিয়ে এত দ্রুত যে এই জগত থেকে সরে যাবেন সেটা বুঝিনি।
উনি সবসময় বলতেন জন্মের মতো মৃত্যুকেও সেলিব্রেট করা দরকার- এটা হয়তো আরো বড় মিলন। ছোট্ট সেই আমি তখন বোকার মতো প্রশ্ন করতাম: আপনি মরে গেলে আমরা কী সেদিন পোলাও-কোর্মা খাবো? উনি বলতেন: অবশ্যই। আমি বলতাম: তবে তো মানুষ আমাদেরকে খারাপ বলবে। আব্বা হেসে বলতেন: আমি যেদিন মারা যাবো সেদিন তোমরা পোলাও -রোষ্ট খাবে। কেউ কিছু বললে, বলবে- আমি তোমাদেরকে খেতে বলে গেছি। আব্বা যেদিন বিকেলে মারা যান, সেদিন দুপুরে আমরা বাসার সবাই পোলাও-রোষ্ট খেয়েছিলাম। সে বছরের সেই দিনটা ছিল একই সাথে আমার জন্মদিন আর ঈদের দিন।
Mamnoon Murshed Chowdhury
He would be proud of you, Hasin.
Hasin
Thanks a lot!
Md Rayhan Shiddique
Happy Birthday friend. May Almighty bless you. Suddenly astonished to see with you at JBFH, please take care of you. My wife’s right leg toe problems, plastered it. After 21 days it will removed. I am very empathised for your father. May Almighty placed him Jannah.
Hasin
Thanks brother!
Golam Mostoga
Nice and heart touching write up, mam. May Allah give jannat to your father and also happy birth day to you.
Hasin
Thank you so much!
Arifujjaman Arju
গভীর মনোযোগের সাথে আপার লেখাটি পড়লাম, কিছুটা নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আবেগের সাগরে।
উপলব্ধি এই যে, আমরা একজন আদর্শ মানুষকে হারিয়েছি যিনি তার আদর্শকে দান করে গেছেন তারই সন্তানের মাঝে।
আপা, আপনার জন্মদিনে জানাই ফুলেল শুভেচছা পাশাপাশি আংকেল এর জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন উনাকে জান্নাতবাসী করেন!
Hasin
Thanks!
Farjana
Awesom. But i have missed all guidance from my father, he is still alive. You are really lucky to learn life skill from childhood that made you so specia.
Hasin
Thanks!