প্রথম হবার বিড়ম্বনা
আমার স্কুলজীবন শুরু হয় লালমাটিয়া গার্লস হাই স্কুল থেকে। তখন নার্সারি-কেজির কোনো বালাই ছিল না। পরীক্ষা কাকে বলে সেটা না বুঝেই জীবনে প্রথম ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম ক্লাস টু-তে। ফলাফল প্রকাশের দিনে আমার মা আমাকে সাথে নিয়ে গিয়ে দেখলেন, বোর্ডে ঝোলানো রেজাল্টশিটে আমার নাম নেই। অর্থাৎ আমি ফেল করেছি। ফেল কাকে বলে তখনও ঠিক বুঝি না।কাজেই আমার কোনো মাথা ব্যথাও নেই। কিন্তু আম্মাকে দেখলাম মহা উত্তেজিত। তিনি আমার হাত ধরে টানতে টানতে সোজা সম্ভবত হেড মিস্ট্রেসের রুমে গিয়ে মোটামুটি চ্যালেঞ্জ করে বসলেন যে, ‘আমার ফেল-এর খাতা দেখাতে হবে’। বাদানুবাদের এক পর্যায়ে উনাকে খাতা দেখানোর জন্য একজন আমার খাতা খুঁজে বের করে তারস্বরে চিৎকার দিলেন, ‘ওমা এ মেয়ে তো দেখি ফিফ্থ হয়েছে!’ আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার আকর্ণবিস্তৃত বিজয়ীর হাসি। বললেন, ‘আপনাদের একটা ভুলের জন্যে আমার মেয়েকে সারাজীবন পরীক্ষায় ফেলের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হতো।’ যাইহোক, সেইথেকে আমার স্কুল শুরু।
স্কুল আমার কখনোই ভাল লাগেনি।
প্রাইমারি স্কুলের টিচারদের আদর-স্নেহ-রাগ কোনটারই তেমন স্মৃতি আমার নেই। তবে স্কুলের মাঠের কোণার টয়লেটে যে ভূত থাকতো বলে শুনেছিলাম, সেটা মনে আছে। মনে আছে বন্ধুদের কথা, বিশেষ করে নাবিলা, রূপা আর ফারিয়া। কাঁধে ঝুলিয়ে কাপড়ের ব্যাগে বই নিয়ে দলবেঁধে স্কুলে যেতাম। হাতে-গোনা কয়েকজন সুটকেসের মতো ব্যাগে বই আনতো। সম্ভবত তারা একটু ধনী পরিবারের ছিল! আমার ঐ সুটকেসের প্রতি ছিল প্রচণ্ডরকম আকর্ষণ ছিল। কিন্তু কেন যেন কোনোদিনই আব্বা-আম্মার কাছে সেটা কিনে দেবার জন্য চাইতে পারিনি।
শারিরীকভাবে আমি ছিলাম খুবই দুর্বল। ভাতেমরা কিসিমের। যেকোনো খেলাতেই অবধারিতভাবে হেরে যেতাম। আরো মনে আছে যে স্টেজে উঠে একবার কবিতা বলতে গিয়ে ভুলে গেছিলাম। সেই থেকে গান-কবিতা-বির্তকের ধারে কাছেও যেতাম না। আমি ভয়ানক রকম স্টেজ-শাই ছিলাম। কোনোদিন স্টেজে উঠে কথা বলতে পারবো তা কল্পনাতেও ছিল না।
সম্ভবত ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে উঠার সময় আমি ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে গেলাম। অংকে বেশি পেয়ে আমার জীবনের প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী, ক্লাসের ফার্স্টবয় মোর্শেদকে পিছনে ফেলে আমি অনায়াসে এগিয়ে গেলাম। মোর্শেদকে আমি বেশ পছন্দই করতাম। তারপরেও ওকে পেছনে ফেলে বিজয়ীর হাসি হাসতে আমার কষ্ট হয়নি।
আর এই ‘প্রথম’ হয়েই খেলাম ধরা! শুরু হলো আমাকে নিয়ে আম্মা-আব্বার প্রত্যাশা আর ‘পিয়ার-প্রেসার।’ তাদের এই প্রত্যাশা আমার শিক্ষাজীবনের বাকি সময়টা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে।
ক্লাস সিক্সে উঠে ভর্তি হলাম ‘বটমলী হোম গার্লস হাই স্কুলে।’ মিশনারি এই স্কুলের রীতিনীতি বেশ অন্য রকম। পড়াশোনার বাইরেও আচরণগত বিষয়গুলো প্রাধান্য পেত। রামকৃষ্ণ, যতীন সরকার, অখিল স্যার, সুপ্রভা আর মারিয়া দিদি, খালেদা আপা, সিস্টার আনিতার স্নেহ-মমতা-শাসনের কথা মনে পড়ে। অনেকের সাথের বন্ধুত্ব এখনও অটুট- শিল্পী, হেলেন, লরেটো, বৃজেট, গ্রেস, তওহীদা, লুবনা। আবার প্রিয় অনেককেই হারিয়ে ফেলেছি।
আমি নিয়মিতভাবে স্কুল ফাঁকি দেবার চেষ্টা করতাম- জ্বর, পেটে ব্যথা, ইত্যাদি নানারকম মিথ্যা বাহানায়। মুখস্থবিদ্যায় আমি ছিলাম ভীষণ দুর্বল, ৮-১২ লাইন কবিতা দাঁড়ি-কমাসহ মুখস্থ করা ছিল রীতিমত দুর্বিষহ। ইতিহাসের সাল-তারিখ মুখস্থ করার কারণ আজও আমার অজানা।
তবে এতোকিছুর পরও, আব্বা আম্মার প্রত্যাশার কারণে এই স্কুলে এসেও ক্লাসের প্রথম স্থানটা ধরে রাখতে হয়েছিল। প্রথম হওয়ার বিষয়টা আমার কাছে নিজের আনন্দের চেয়ে আম্মা-আব্বার প্রত্যাশা পূরণের জন্যই বেশি জরুরি বলে মনে হতো। পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রত্যাশাও কম ছিল না। ক্লাস এইটে থাকতে আমার হলিক্রস স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। হেড মিস্ট্রেস সিস্টার মেরীপেট্রা মন খারাপ করে আব্বাকে বললেন যেন আমার স্কুল না বদলানো হয়, উনি চান আমি তার স্কুল থেকে পাশ করে তারপরে যেন হলিক্রস কলেজে পড়ি। আব্বা উনার কথা রাখলেন।
প্রতিটা পরীক্ষার আগে আর রেজাল্ট বেরুনোর সময় ঘনিয়ে আসলে কি যে অমানবিক মানসিক চাপে পড়তাম, তা কেবল আমিই জানি! সব পরীক্ষার আগে আব্বাকে জিগেস করতাম, ‘আমি এবার ফার্স্ট না হতে পারলে কী আপনি মন খারাপ করবেন?’ উনি সহজ গলায় বলতেন, ‘আগে পরীক্ষা তো দেও, পরে দেখা যাবে’। কিন্তু আমি জানতাম, আমার আর পিছু-হটার কোনো সুযোগ নেই।
যে সরকারি কলোনিতে থাকতাম, সেখানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন, পাড়ার চাচা-চাচি আর স্কুল-পড়ুয়াদের কাছে ছিলাম ‘আদর্শ ছাত্রী’।
রেজাল্ট বেরুনোর পরে তখনকার দিনের প্রথা অনুযায়ী চলতো রসগোল্লা বিতরণ।
তবে ভালো রেজাল্টের কারণে না চাইতেও অনেক সময়ে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে আমার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বুঝতে পারতাম যে পাড়ার চাচিরা আমাকে উদাহরণ হিসেবে নিয়মিতভাবে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন। তবে এতোকিছুর পরেও শেষ পর্যন্ত আমার আর এই চক্র থেকে বের হওয়ার সুযোগ হয় না!
তখনকার দিনে প্রাইভেট বা কোচিং-এ পড়ার চল থাকলেও, আব্বা আমাকে শুধুমাত্র এসএসসি-র টেস্ট পরীক্ষার পরে মাত্র তিন মাসের জন্য প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
এসএসসি পরীক্ষা চলার মাঝখানে আমার হঠাৎ জ্বর আসে। তখন ‘কট্রিম’ একটা বেশ পপুলার ওষুধ ছিল। ওটা খাওয়ার পরপরই সালফার ড্রাগের রিএকশ্যানে আমি ফুলে ঢোল হয়ে গেলাম। আমার সিট পড়েছিল বিজ্ঞান কলেজে। অসুস্থ অবস্থায় পরীক্ষা দেব বলে সেখানের টিচাররা আমাকে শুয়ে শুয়ে পরীক্ষা দেবার জন্য অনুমতি দিলেন। বাসা থেকে মাদুর-চাদর নিয়ে মেঝেতে কিছুক্ষণ শুয়ে আর কিছুক্ষণ বেঞ্চে মাথা ঠেকিয়ে আধবসা হয়ে অংক পরীক্ষা দিলাম। একথা জানতে পেরে সিস্টার মেরীপেট্রা আমাকে দেখতে আসলেন। আমাকে নিয়ে উনার এতো প্রত্যাশা বুঝি আর পূরণ হলো না! মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে দুটো পরীক্ষার পরে আবার ক্লাস রুমে ফিরে এলাম।
অবশেষে রেজাল্ট বের হলো। হ্যাঁ, সবার প্রত্যাশা পূরণ করে, অনেক নিচের দিকে হলেও আমি অন্তত মেধাতালিকায় জায়গা করে নিলাম।
বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের সিস্টার মেরীপেট্রার প্রথমবারের বললেন, ‘আই এম প্রাউড অফ ইউ।’ বাসায় ফিরে আব্বা খুব নরম গলায় বললেন, ‘মা, তুমি আমার ছেলেদের চাইতেও ভালো রেজাল্ট করেছ। আমি এতটা ভাল আশা করিনি। জানলে তোমাকে আরেকটু বেশদিনের জন্য প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবস্থা করতাম।’
অসংখ্যবার মনে হয়েছে আমি প্রতিযোগিতার এই চক্র থেকে মুক্তি চাই! কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি। দিনরাত ঘাড়গুঁজে পড়ালেখা করে ‘প্রথম’ হওয়ার চাইতেও যেটা জরুরি তা হলো- ‘লাইফ-স্কিল’ শেখা। পরীক্ষায় প্রথম হয়ে যা শিখেছি, তারচেয়ে অনেক বেশি শিখেছি জীবনে ধাক্কা খেয়ে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি সেসব।
ছোটবেলা থেকেই একটা প্রচলিত কথা শুনতাম- ছেলেদের অংকে মাথা ভালো। এটা শুনলে আমি বরাবরই তাচ্ছিল্যের মুচকি হাসতাম। বেশিরভাগ পরীক্ষাতে অংকে এগিয়ে থেকেই আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে খুব সহজে ধরাশায়ী করেছি। সবসময় ভাবতাম পাটিগণিত, বীজগণিত কিংবা হায়ার ম্যাথ- সবটাই পানির মতো সহজ। এতে তো আর মুখস্থ করার বালাই নাই। তবে জীবনের শেষ অংকে এসে বুঝেছি- আমি আসলে অংকে কত কাঁচা! জীবনের পাতায় পাতায় হিসেবে কত ভুল করেছি।
নিজের জীবনে ‘প্রথম’ হবার যে মরীচিকার পেছনে ছুটেছি, তা আমার ছেলেদের জীবনে আমি হতে দেইনি। পিয়ার-প্রেসারের বলয়ে ওদেরকে কখনও পড়তে দেইনি। বলেছি শুধু পাশ করলেই চলবে, ফার্স্ট হবার দরকার নেই। নামীদামী স্কুলে ভর্তি করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করিনি, যে নম্বর পেয়েছে সেটার সাথে যে প্রথম হয়েছে তার তুলনা করে বকাঝকা দেইনি। তারা কেউ গান-কবিতা-ছবি আঁকা শিখতে চায়নি। আমিও ছুটির সকাল মাটি করে তাদেরকে সর্ববিষয়ে পারদর্শী করার চেষ্টা করিনি। GPA, A level বা O Level এর রেজাল্ট শেয়ারের স্রোতে গা ভাসাই নাই।
আমার ছোট ছেলেরও স্কুলে পড়ার সময় মাঝেমধ্যেই সকালবেলায় পেটে-মাথায় (আমার মতো) ব্যথা হতো! আমি মুচকি হেসে অফিসে রওনা হতাম। একটাই জীবন! আর এই অভিনয়ও (যদিও খুব অপরিপক্ব) একরকম লাইফ-স্কিল। আস্তে আস্তেই পরিপক্বতা আসবে!
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাই ‘শিক্ষা’র সবচেয়ে বড় সুযোগ তৈরি করে। অথচ আমরা বেশির ভাগ সময় একই ভুল বারবার করি। আবার অন্যের জীবনেও নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে চাপিয়ে দেই! জীবন যুদ্ধে নিজের জায়গা নিজেকেই করতে হবে।
Jaya Sarker
Khub valo laglo.. aro valo laglo amr school r teacher der nam gulo dekhe.. koto memory oi school k ghire r koto valo laga..Thanks for sharing
হাসিন জাহান
Great to know that you are from the same school!