আমি বাবার মতো হতে চাই
এপ্রিলের দুই তারিখে গেটস ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় খুলনায় আয়োজিত এক ওয়ার্কশপে উপস্থিত নারীদের নিয়ে একদিন ব্রেকফাস্ট-মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটা নতুন কিছু নয়! বিদেশে এ ধরনের ‘মিটিং ওভার ব্রেকফাস্ট’-এর চল মোটামুটি নিয়মিত। তবে আমি এর ঘোরবিরোধী। কারণ সকালের সময়টা অতি-ব্যক্তিগত! নানাজনের নানা অভ্যাস। কেউ নাস্তা খেয়ে টয়লেটে যান, কেউ আবার টয়লেট সেরে নাস্তা খান। কেউ চা-কফি দিয়ে দিন শুরু করেন, কেউ আবার ইসুফগুলের ভুশি। নাস্তায় মিটিং কালচার বরাবরই আমার অপ্রিয়। তারপরে যদি আবার শাড়ি পরার ফ্যাকড়া থাকে!
যাহোক পেটের দায়ে সেদিন সাতসকালে শাড়ি পরে এক রকম অনাগ্রহ নিয়েই ব্রেকফাস্টে গেলাম। সাদামাটাভাবে আলোচনা শুরু হলেও, কিছুক্ষণ বাদেই একটা অন্যরকম অনুভূতি পেতে শুরু করলাম।
এলিস, অনুষ্ঠানের আয়োজক, শুরুতেই প্রত্যেককে তার ছোটবেলায় কে এবং কিভাবে তাকে অনুপ্রাণিত করেছেন, বড় হয়ে কে কী হতে চেয়েছিলেন আর শেষ অবধি কী হয়েছেন এ বিষয়গুলো নিয়ে ছোটখাট একটা বর্ণনা দিতে বললেন।
ঝাঁপি খুলে এবার নানাজনের গল্পের পাখনা মেললো। আমি কিছুটা অবাক হয়েই শুনতে থাকলাম। বিশ্বখ্যাত রাজনৈতিক নেত্রী থেকে শুরু করে অনেক গুণীজনের নাম এলো। আমার নতুন করে মনে হলো ‘মানুষ তার স্বপ্নের মতো বড়।’ কারো কারো সহজ স্বীকারোক্তি ছিল, ছোটবেলায় তেমন কিছু ভাবেননি- তবে একজন ভালো মানুষ হতে চেয়েছিলেন। কথাটা আমার মন ছুঁয়ে গেল। সব মিলিয়ে প্রায় জনা বিশেক অংশগ্রহণকারী ছিলেন। তার ভেতরে আমিসহ কমবেশি চল্লিশ শতাংশই জানালো যে, তারা তাদের বাবার মতো হতে চেয়েছিলেন। শুধু তাই না, কেন হতে চেয়েছিলেন সেটা ব্যাখ্যা দেবার সময় অনেকেই তাদের বাবাকে পরিচিত করালেন নানা উপমা আর উদাহরণে যেমন, ক্যারিশম্যাটিক ক্যারেক্টারের অধিকারী, অসাধারণ বিচক্ষণতা আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, চমকপ্রদ ও অনুকরণীয় লিডারশিপ, ইত্যাদি। কমবেশি তাদের সবার বাবার কর্মযজ্ঞই ছিল আকর্ষণীয়।
আলোচনা শুনতে শুনতে হঠাৎ আমার মনে একটা বড় রকম খটকা লাগলো। অবাক হলাম, উপস্থিত কেউই কিন্তু তাদের মায়ের মতো হতে চাননি! কিন্তু কেন? এর উত্তর আমি খুঁজে পাইনি। আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারণ অন্য অনেকের মতো আমিও আমার বাবার মতোই হতে চেয়েছিলাম। সম্ভবত আমার বাবার জৌলুসপূর্ণ জীবনটাই আমি চেয়েছি! আমার মতো অনেকেই মাকে ভালবাসলেও কেউই আমরা আমাদের মায়েদের মতো ট্রেডিশনাল জীবনটাকে অনুকরণ করতে চাইনি বরং বাবাদের মতো সফল হতে চেয়েছি।
যাহোক ব্রেকফাস্ট মিটিং-এর পরের দফার আলোচনায় এসেছে বর্তমান সময়ে সবার জীবন কেমন কাটছে এবং কিভাবে তা আরো ভালো হতে পারে।
পুরো আলোচনাটাতে সবাই গঠনমূলক অংশগ্রহণ করলেন এবং চমৎকার সব প্রস্তাবনা রাখলেন। তাদের বক্তব্যে কিভাবে কাজ শেখা যায় এবং সীমিত সুযোগকে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়ে আলোচনা শুনলাম। কাউকে বলতে শুনিনি, যে অনেক কাজের চাপ, দক্ষতার অভাব অথবা আর্থিক সুবিধা বাড়ানো দরকার। কোনো ফ্রাস্টেশন বা অভিযোগ-অনুযোগের কোনো বার্তা কানে এলো না। আমার জানা মতে কম করে হলেও তিনজন ‘একক মা’ সেখানে উপস্থিত ছিলেন, যারা প্রত্যেকেই কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল। তারপরও শুনিনি কারো বাড়তি কোনো প্রত্যাশা। আমার গর্ব হয়েছে যখন বুঝেছি এখানে প্রত্যেকেই জীবনযুদ্ধে পারদর্শী একেকজন সৈনিক।
অনেক কথার ফাঁকে যে আরো যেসব বিষয় এসেছে তার মাঝে অন্যতম হলো, এখন সময় এসেছে ভেবে দেখার কিভাবে পৈত্রিক সম্পত্তি ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা যায়। এটাই হতে পারে নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ। এখানে উল্লেখ্য, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখনও এবিষয়ে উনার বহুল আলোচিত বক্তব্যটি দেননি।
জীবন থেকে নেয়া গল্পগুলোর একটি ছিল একজন পৌর-কাউন্সিলরের, যিনি একই পৌরসভার একজন সাধারণ পৌরকর্মীর স্ত্রী। বিষয়টি তাঁর জন্য খুব সহজ ছিল না। তাঁকে কাউন্সিলর পদে অধিষ্ঠিত হতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তারপরেও তিনি থেমে থাকেননি, সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, এটাও সম্ভব। এরকম অনেক অজানা গল্পের মাঝে আমাদের সময়টুকু স্মরণীয় হয়ে উঠলো।
এর মাঝে আমার মনের কোণে আরো কিছু স্মৃতি জ্বলে উঠলো। আটানব্বই সালে আমি যখন টেকনোলজি স্পেশালিস্ট হিসেবে ‘আইটিএন বুয়েট’-এ যোগ দিলাম, তখন বুয়েটের কোর্স কারিকুলায় ওয়াটার সাপ্লাই ও স্যানিটেশনের ‘লো-কস্ট টেকনোলজি’ অথবা ‘জেন্ডার’ নিয়ে কোনো বিষয় ছিল না। পরবর্তীতে ‘ওয়াটার সাপ্লাই এ্যান্ড স্যানিটেশন, রুরাল এ্যান্ড লো-ইনকাম কম্যুনিটি’ বইটিতে প্রফেসর ফিরোজ আহমেদ এবং প্রফেসর মুজিবুর রহমান ‘জেন্ডার’ সংক্রান্ত একটি অধ্যায় সংযোজন করেন। সেটাই সম্ভবত বুয়েটের কারিকুলায় জেন্ডার বিষয়টিকে সংযোজনের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম উদ্যোগ ছিল। আমার এখনো মনে আছে সেই সময়ে এক ‘ডাচ’ নারী বাংলাদেশে এসে বইটা লেখায় সহযোগিতা করেন। তার সাথে কাজ করার সুবাদে তখনই প্রথম আমার জেন্ডার বিষয়টির গভীরে ঢোকার সুযোগ হয়।
‘পানি ও স্যানিটেশন’ সেক্টরে কাজ করছি তাও প্রায় বিশ বছরেরও বেশি। জীবনে বহুবার বড় বড় অনুষ্ঠান-আয়োজনে অনেক মানুষের ভিড়ে একমাত্র নারী হিসেবে নির্বিকারভাবে অংশগ্রহণ করেছি। স্যানিটেশন নিয়ে মেয়ে হয়েও অবলীলায় কথা বলেছি। মাঝেমধ্যে একটু অস্বস্তি যে একেবারেই হয়নি, তা বলবো না।
তারপর জল বহুদূর গড়িয়েছে। সেসব দিনের অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেক মেয়েকেই দেখছি এই সেক্টরে কাজ করছেন। তারপরেও এই সংখ্যা শতকরা মাত্র ১০ শতাংশ। মেয়েদেরকে এই সেক্টরে আসার জন্য আমাদের উচিত তাদেরকে উৎসাহিত করা। পাশাপাশি মেয়েদেরও এই সেক্টরে কাজ করতে আগ্রহী হওয়া দরকার। তাদের উচিত যেখানে যতটুকু সুযোগ পাওয়া যায়, সেটুকুর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিজেকে গড়ে তোলা। মাঠের অভিজ্ঞতা, লেখালেখি, উপস্থাপন সবটাই জরুরি। শুধুমাত্র নয়টা-পাঁচটা এসি রুমে অফিস করার মানসিকতা থাকলে শুধু চাকরিই করা হবে, কাজ শেখা হবেনা। কাজ শিখতে গেলে ভুল হবে, ভুল হলে তার কারণ অনুধাবণ করে তা’ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে হবে। সামনে যেতে হলে পরিশ্রম করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। প্রফেশনাল জগতে নিজের জায়গা করে নিতে গেলে, আসলে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তুলতে হয় আর সেই দ্বায়িত্ব তার নিজেরই।
Hasin
ধন্যবাদ!