তোমাদের জন্য ভালবাসা
কদিন আগে ঘুরে আসলাম ট্রাম্পের দেশ থেকে। হিউস্টন এয়ারপোর্ট থেকে ইকোর সাথে ওর বাসায় পৌঁছাতেই দেখি টেবিলে সপ্তব্যঞ্জনসহ ধোঁয়া উঠা গরম ভাত। খাওয়ার একপর্যায়ে ওর বৌ, তানি সলজ্জ ভঙ্গিতে বললো: আপা, মুরগি খাওয়া যাচ্ছে তো? ইকো আপনার জন্য গতকাল জবাই করা দশটা মুরগি এনেছে, যদি দেশ থেকে এসে এখানকার মুরগি খেতে না পারেন! প্রতিউত্তরে আমি রাগে কটমট করে ইকোকে বললাম, তুই মর!
পরদিন সকালে ইকো বললো: সবসময়ই তো শপিং মলে ঘুরিস, আজকে আমার সাথে সাথে থাক। ইকোর অফিসের এমপ্লয়ি সেজে সাইনআপ করে দুইজন মিলে ‘প্রিবিড মিটিং’-এ গেলাম। বের হতেই বললো: আখের রস খাবি? কি বলিস! জন্ডিসের ভয়ে দেশেই তো কোনদিন খাইনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই জীবনে প্রথমবারের মতো আমেরিকার মাটিতে আখের রস খেলাম!
পরদিন সন্ধ্যায় হিউস্টনের ব্যাচমেটদের সাথে জম্পেশ আড্ডাসহ ডিনার।

রিলে রেসের মতো তিনদিনের মাথায় ইকো পৌঁছে দিল নাহিদ-কনকের কাছে অস্টিনে।
নাহিদের নির্ধারিত প্যাকেজ অনুযায়ী চললো পরের তিনদিন। অস্টিন আর স্যান এন্টানিওর দর্শনীয় জায়গায় সফরের পাশাপাশি টেক্সাসের ঐতিহ্যবাহী সিক্স-রিবের ডিনার, মুভি, ফটোসেশন- পুরোটা সময় ছিল নাহিদ আর কনকের সযত্ন প্রয়াস!

অস্টিনে রূপার সাথে দেখা- ঠিক পঁচিশ বছর পরে। রূপার বাসায় দাওয়াতে হরিণের আর ঘুঘুর মাংস খেলাম- দুটোই রিয়াজের শিকার করা।
রুপার সাথে বন্ধুত্ব ক্লাস টু থেকে।সিক্সে উঠে আলাদা স্কুলে, আবার পরে বুয়েটে। রূপা, তোর মনে আছে? ছোটবেলায় তোর সাথে কি ভীষণ ঝগড়াটাই না করেছি নাবিলাকে নিয়ে- কার সাথে বেশি বন্ধুত্ব! স্কুল ছাড়ার আগে সেই যে আমরা আড়ি নিয়েছিলাম, আর কখনও ভাব নেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত দুই যুগ পেরিয়ে তারপর ‘ভাব’ হলো!
আমি যাবো শুনে শেলীর আয়োজনে দেখা হলো বুয়েটের সিনিয়র-জুনিয়র আরো কত নতুন মুখ। ফেসবুকে ‘আড়িপাতা’র কল্যাণে অনেকেই কত চেনা! নাতালীর সাথে দেখা হয়ে মনেই হলো না যে এটাই আমাদের প্রথম দেখা। ‘আড়িপাতক’ রেহনুমার সাথেও দেখা হয়েছিল তার বরসমেত।
অস্টিনপর্ব শেষে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে এসে নাহিদ কড়া গলায় বললো: সিকিউরিটি পার হয়ে গেট খুঁজে সেখানে বসে তুই আমাকে ফোন দিবি। তারপরে আমি বাসায় যাবো। আমি যেতে যেতে অনুভব করলাম পিছনে দাঁড়ানো তোর উৎকন্ঠা আর ভালবাসা!
ফিনিক্স এয়ারপোর্ট থেকে ডালিয়া নিয়ে এলো সোজা ওর বাসায়। একে একে যোগ হলো শারমিন, রেনজিনা, ইমা আর সাঁঝ।
সেই যে আমাদের কথা শুরু! ছোটবেলার মতো! কখনও লেপের ভেতর পা ঢুকিয়ে বা বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে, কখনও ডাইনিং টেবিলের চারপাশে জড়ো হয়ে শুধু গল্প আর গল্প। ক্ষণে ক্ষণে একজন আরেকজনকে পঁচানো আর সেই পুরোনো দিনের স্মৃতিকথা- কী যে আনন্দ। ডালিয়া-শারমিনের সাথে তো পুরো একটা রাত শুধু কথা বলেই কাটালাম!


গ্রান্ড ক্যানিয়নে ঘুরতে গিয়ে নজরে পড়লো ইমার ঝকমকে নাকফুল! ও জানালো যে এদেশে নাক ফুটো করলে কোনো ব্যথা পাওয়া যায় না! ইমার আশ্বাসের ভিত্তিতে তাতক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাকেও নাকফুল পরতে হবে। সারাজীবনে নিতে না পারা এই কঠিন সিদ্ধান্ত কীভাবে যে এত সহজে নিয়ে নিলাম! অতি উৎসাহে পরদিন ডালিয়া ট্যাটু করানোর দোকানে নিয়ে আমাকে নাক ফুটো করালো। ঘটনা ঘটার পরে বুঝলাম যে, কত ধানে কত চাল – ব্যথা আসলে ঠিকই পাওয়া যায়। ছোটবেলার মতো ধরা খাওয়ার পরে বেমালুম চেপে গিয়ে এবার আমরা সবাই মিলে রেনজিনার নাকে ফুল পরানোর ব্যবস্থা করলাম। ব্যাপক এই সাফল্যে গর্বে ইমার তো আর মাটিতে পা পড়ে না!

চলছে ফিনিক্সবাসীদের রিইউনিয়নের প্রস্তুতি। আর বহিরাগত আমাদের পোয়াবারো! কখনও ঘুরতে যাওয়া, কখনও শপিং, ফ্যাশন শো-এর জন্য রিহার্সেল- ঠিক যেন বুয়েটের শেষদিকে র্যাগের প্রস্তুতি।

রিইউনিয়নের মূল দুদিন হোটেল হিলটনেই কাটালাম সবার সাথে। সব মিলিয়ে মোট আটানব্বই জন বন্ধু একসাথে হয়েছিলাম। লিভি-তনু, আজিজ, দ্বীপ, আবেদ, কুশল, জিয়া মঈন, ফারহানা, নাদিরা, ফারহানা মান্নান, রচনা-মানস, দীনা, লায়লা-তানভীর, অনুপ আর অনেকেরই সাথে দেখা হলো প্রায় পুরো পঁচিশ বছর পরে! কখনও ভাবি নাই, কানাডাবাসী স্বপন আর অনিমেষের সাথে দেখা হবে আমেরিকায়। কানাডায় যাবো বলে কথা নিয়ে তবেই অনিমেষ ক্ষান্ত হয়েছে। তোরা সবাই ঠিক একই রকম আছিস, একটুও বদলাস নাই!


দেশে আসা-যাওয়ার সুবাদে কালেভদ্রে দেখা হলেও আরো একবার দেখা আর আড্ডা হলো ফিরোজ, রনি, সাজ্জাদ, রানা-কাঁকন, কামেলা, বিউটি, লায়েক, সাব্বির এবং আরো অনেকের সাথে।
হালিম, সেলিম আর আরো অনেক সদ্যপ্রবাসীর সাথেও দেখা। আগে তেমন পরিচয় না থাকলেও সালেকিন, তারিক, নাজমুল, শাকিল, আরিফ আর আরো অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব হলো সহজেই। আমি ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে এসেছিল মঞ্জু, ফোরকান, দেলওয়ার আর বারেক। সে এক বিশাল যজ্ঞ!

মানসী, কণক, মাহফিল, সোহেল (কাউয়া), রেজাউল, কনক, নাজ, রফিক, আনাম, ওয়াজেদ, মুসা এবং আরো অনেকের অনুপস্থিতি অনুভব করেছি।

সাঁঝের বিয়ের পর ওর নতুন বরকে নিয়ে আমরা সাত বন্ধু সিভিল বিল্ডিং-এর সামনে রীতিমতো একটা ঐতিহাসিক ফটো তুলেছিলাম। পঁচিশ বছর পরে দুলাভাইসহ আবার আমরা সেই সাতজন একসাথে হতে পেরেছি। সবাই মিলে সেই একই ভংগীতে আবারও ক্যামেরাবন্দী হয়ে ইতিহাসের এক অবিশ্বাস্য পুনারাবৃত্তি করলাম !

ফিনিক্সের পুরোটা সময়জুড়ে চলেছে যেন ঈদ আয়োজন। দলবেঁধে এক এক বাসায় যাওয়া-খাওয়া-গল্প। আবার আরেক বাসায়! রশিদ, গাজী, মিজান, সাজ, ইমা, ডালিয়া, রচনা, তুহিন সবার বাসায় দফায় দফায় আনন্দ আয়োজন। বন্ধুপত্নীদের আপ্যায়ন ছিল তুলনাহীন। সেইসাথে মোয়াজ্জেম ভাইয়ের হাতের টার্কি, আরিফ আর আরেফীন ভাইয়ের স্নেহের কথা ভুলবো না।
আনন্দের বন্যায় চোখের নিমেষে কেটে গেল সময়টুকু। ফেরার সময় ব্যাগ গুছাতে গিয়ে চরম বিপত্তি। দুই-তৃতীয়াংশ জিনিস ভরতে না ভরতেই ব্যাগের জায়গা শেষ। আমার ছ্যারাব্যারা অবস্থা দেখে শারমিন নিজেই আমার ব্যাগ গুছাতে বসলো। ও গুছানো শেষে কীভাবে যেন এক্সট্রা জায়গাও বের করে ফেললো!
আমাদের ব্যাচের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আমার আমেরিকা যাবার সিদ্ধান্তটা ছিল অনেকটা হঠাৎ করেই। তবে একটা প্রত্যাশা ছিল যে হাসানের সাথে দেখা হবে। হাসান আমাদের এই সংগঠনের অন্যতম কর্ণধার। বছরের পর বছর আমাদের সবাইকে এক সুতোয় ধরে রাখার দুর্নিবার প্রাণশক্তি। হাসান,
তোমার সাথে কিছুটা সময় কাটানো ছিল আমার এক বিশাল পাওয়া। তোমার শরীরে জন্ম নেয়া কর্কট রোগের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ তুমি নেমেছ, তাতে জয়ী হও! তোমাকে আমাদের অনেক প্রয়োজন।

ফেরার সময় প্লেনে ওঠার ঠিক আগমূহুর্তে আমার মতো শক্তমনের মানুষের চোখ থেকে অজান্তেই ক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। যত দূরে যাই, জেন বন্ধুরা, আমি তোমাদের কাছেই আছি!

Wazed
অল্প কথায় বন্ধুত্বের সুদৃঢ় গাঁথুনি, ১৯৭৬-২০১৮, প্রাইমারি স্কুল -বুয়েট-আমেরিকা সব কিছুই চলে এসেছে তোমার লেখনিতে। ভাল লেগেছে। প্রগ্রামে অনিচ্ছাকৃত অনুপস্থিতিতে যা মিস করেছি তা আরো বেশি করে টের পাচ্ছি তোমার লেখা পড়ে।
হাসিন জাহান
We missed you!
Javed Bari
আমার প্রায় এক যুগের আবাসস্থল এরিজোনাতে আমাদের ব্যাচের রিইউনিয়নটি খুব মিস করেছি। তোমার ওখানকার ভাল লাগার অনুভূতি আর আরো আগের পুরনো স্মৃতিকথন আমাকেও অনেকটুকু ছুয়ে গেছে। খুব ভাল লাগলো তোমার লেখাটি।
হাসিন জাহান
Hmm had a great time indeed