হাসিন জাহান
ঢাকা, বাংলাদেশ

আমি হাসিন। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছেছি জীবনের প্রায় মাঝ বরাবর। পথ চলতে চলতে অনেক কিছু দেখা হয়েছে, জানা হয়েছে, শেখা হয়েছে। অনেক সময় চোখের দেখার বাইরেও অনেক বিষয় অনুধাবন করেছি ভিন্নভাবে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই বোধহয় এক একটা উপন্যাস। আমার জীবনের উপন্যাসের পাতাগুলো থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে ডিজিটাল স্মৃতির খাতায় জমা রাখার জন্য এই ব্লগ। আর তাতে যদি কারো ভালো লাগে, সেটা হবে বাড়তি পাওনা। একটাই জীবন, তাই এর প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠুক আনন্দময় আর আলোকিত!

খোঁজ করুন
খোঁজ করুন
পথ চলতে

ছোট ছোট ঘটনা, বড় বড় ঋণ (২)

on
September 23, 2023

১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এর সকালে জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই মন কাড়লো নিউ ইয়ার্কের ঝকঝকে নীল আকাশ!

সুটকেস সমেত ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে উবার ডেকে পিক আপ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। ট্রাফিক জ্যামের কারণে চালক সহজে আমার কাছে পৌঁছতে পারছিলেন না। যাহোক, কিছুক্ষণের মধ্যে আধভাঙ্গা ইংরেজিতে কথোপকথন শেষে গাড়িতে চেপে বসলাম।

চালক প্রথমেই উষ্মা প্রকাশ করলেন ইউএন-এর অনুষ্ঠানের উপরে। এদের এই আয়োজনের কারণে অতিরিক্ত ভীড় আর তাদের এই বিড়ম্বনা! কেন যে এসব লোকজন এই দেশে এসে ভীড় করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে! শুনে লজ্জ্বায় আমি ইতিউতি তাকাই, এই অপরাধীদের আমিও যে অন্যতম একজন।

যাহোক, একটু পরেই চালক একগাল হেসে আমাকে বললো, আমি ইউক্রেনবাসী, তোমাকে আমার দেশের চকলেট দিয়ে ওয়েলকাম জানাই। এই বলে মাথা ঘুরিয়ে তিনি আমার হাতে হলুদ মোড়কের একটা চকলেট ধরিয়ে দিলেন। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যাগে ভরে ফেললাম।

হোটেলের পথে যেতে যেতে কিছু খুচরা কথাবার্তা চলছিল। উনি জানালেন, এদেশে প্রায় আট বছর ধরে আছেন, শুরু থেকেই ট্যাক্সি চালান। স্ত্রী-সন্তান অন্য শহরে থাকে। এখানে খরচ বেশি, তাই মাঝে মধ্যে এখানে আসেন। আমার দেশের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলেন। জিনিসপত্রের তুলনামূলক দাম নিয়ে কথা বলার একফাঁকে মাথা ঘুরিয়ে আমাকে এবার একটা ছোট পানির বোতল হাতে দিয়ে বললেন, এটা স্প্রিং ওয়াটার! পিপাসা লাগলে যেন খেয়ে নেই। আমি বাংগাল, মনে মনে ভাবতেছি, ‘দূরপাল্লার যাত্রায় অপরিচিত কেউ কিছু খেতে সাধলে খাবেন না!’ সেই নীতি অনুসরণ করে, আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে সীটের উপর বোতলটা রাখলাম। কিছুক্ষণ পরে পকেট থেকে একটা কৌটা বের করে আমাকে দেখিয়ে বললেন যে তিনি এটা কিছুক্ষণ পরপর খান। কৌটার মুখ খুলতেই তামাকের প্রচন্ড ধক! আমি তো এইবার পুরাপুরি নিশ্চিত, এই লোক বোধহয় বিদেশি অজ্ঞানপার্টির সদস্য! তাড়াতাড়ি মোবাইলে রুট চেক করি, ঠিক পথে যাচ্ছি কিনা! আর কোন রকমে হু-হা করে সময় পার করছি। একসময় হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াতেই হাঁফ ছেড়ে বাচঁলাম। নামার সময় আস্তে করে সেই পানির বোতলটা (পড়ুন ঘুমের ওষুধ মেশানো ডাব) সীটের উপর রেখে সুটকেস- হাতব্যাগ সমেত হোটেলের এন্ট্রান্সের দিকে প্রাণপণে হাঁটা ধরলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পিছন থেকে চিৎকার – ইংরেজি কেউ বললো আমি গাড়িতে কি যেন ফেলে এসেছি। আতংকিত হয়ে পড়লাম, আমার পাসপোর্ট না তো! যাহোক ফিরে তাকাতেই দেখি বিশালদেহি সেই চালক সহাস্যে তার পানির বোতল নিয়ে দাঁড়ানো। বললো, তুমি তোমার পানির বোতল ফেলে রেখে গেছো! অগ্যতা পানির বোতলটা নিয়েই ক্ষান্ত হলাম!

কদিন বাদের কথা। অফিসিয়াল এক হাই-প্রোফাইল ডিনারে গেছি – হাতে গোনা অভ্যাগতদের জন্য ফর্মাল ডিনার। শুরুতে হোটেলকর্মী ড্রিংকের চয়েস জানতে এসেছেন। আমার গলার অবস্থা খুবই খারাপ। করুণভাবে বললাম ‘ওয়ার্ম ওয়াটার’ পেতে পারি কিনা? আমাকে হচকচিয়ে দিয়ে বললেন ‘ওয়ার্ম ওয়াটার’ নাকি ‘হট ওয়াটার’? বলার ধরন থেকে বুঝলাম, যে ক্রাউডের মাঝে আছি সেখানে আমার চাহিদা মোতাবেক ড্রিংকটা খুব একটা সম্মানজনক আইটেম না! যাহোক জানালাম, একটা হলেই চলবে।

একটু পরেই অতিথিরা সব চলে আসলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চললো পরিচয় পর্ব আর ইনফর্মাল আলাপ। একটু পরেই দেখি হোটেলকর্মী (এই আয়োজনের সুপারভাইজারের দায়িত্বে) আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলছেন, আপনি বাংলাদেশ থেকে আসছেন! আমি তো ভাবছিলাম, আপনি ইন্দোনেশিয়ার। মনে মনে বললাম, আমাকে এরকম অনেকেই নেপালি, ভিয়েতনামী, শ্রীলঙ্কান আরো অনেক কিছুই ভাবে – আমার বোঁচা নাকের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস নতুন না! যাহোক একটু পরেই শুরু হলো ‘এক্সট্রা খাতির’। আমার জন্য আলাদা ট্রেতে কেটলি- কাপ- গ্লাসসহ গরম পানি-লেবু নিয়ে এসে হাজির। সাথে রিফিল করার জন্য বাড়তি আয়োজন – সে এক ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা! ডিনারের আয়োজক আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন আর আমি না দেখার ভান করছি।

কিছুক্ষণ বাদে যখন ওর্ডার নেয়ার পালা, তখন সেই দেশি ভাই সবার সাথে ইংরেজিতে চট করে অর্ডার নিলেও, আমার পাশে এসে বাংলায় কথা বলেন, কোনটা নিলে ভালো হবে, মজা হবে, ইত্যাদি।

যাহোক খাবার শেষে কথা বলার একটু সুযোগ পেয়ে তিনি জানালের, কোভিড-পরবর্তী সময় তিনি কাজ শুরু করেছেন- আয়রোজগার দরকার, বসে তো থাকা যাবে না। টুকটাক কথার পরে বের হয়ে আসবো, সেসময় আস্তে করে বললেন, ম্যাডাম, নিউইয়র্কে সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করেই অনেক ঠান্ডা পড়ে, সাথে গরম কাপড় রাখবেন- অন্তত সোয়েটার আর মাফলার। আমি একজন বয়স্ক মানুষ, অথচ আমাকে কত আন্তরিকতা নিয়ে উনি কথাগুলো বললেন –  যেন আমি একজন ছোট মানুষ, উল্টোপাল্টা করে ঠান্ডা বাঁধিয়ে ফেলবো! একটা অচেনা মানুষের জন্য এ কেমন মায়া! হঠাৎ মনে হলো আমি চোখে ঝাপসা দেখছি, তাই তাড়াতাড়ি হোটেলের বাইরে পা বাড়ালাম!

ফেইসবুক কমেন্ট - Facebook Comments
TAGS

LEAVE A COMMENT