হাসিন জাহান
ঢাকা, বাংলাদেশ

আমি হাসিন। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছেছি জীবনের প্রায় মাঝ বরাবর। পথ চলতে চলতে অনেক কিছু দেখা হয়েছে, জানা হয়েছে, শেখা হয়েছে। অনেক সময় চোখের দেখার বাইরেও অনেক বিষয় অনুধাবন করেছি ভিন্নভাবে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই বোধহয় এক একটা উপন্যাস। আমার জীবনের উপন্যাসের পাতাগুলো থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে ডিজিটাল স্মৃতির খাতায় জমা রাখার জন্য এই ব্লগ। আর তাতে যদি কারো ভালো লাগে, সেটা হবে বাড়তি পাওনা। একটাই জীবন, তাই এর প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠুক আনন্দময় আর আলোকিত!

খোঁজ করুন
খোঁজ করুন
জীবন যেখানে যেমন

একটি আধিভৌতিক ঘটনা

on
October 26, 2018

মেয়েরা যাদের সাথে যেকোনো মূল্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে, তারা হলেন দর্জি। তবে একই সাথে চলে রাগারাগি, মান-অভিমান পর্ব। ব্লাউজের মাপ ঠিকমতো না কেটে অথবা অতি শখের ড্রেসের বারোটা বাজিয়ে এই ‘দর্জি প্রজাতি’ যে কতো নারীর চোখের জল ঝরিয়েছেন, তার কোনো অন্ত নেই! টাইমমতো এবং মাপমতো কাপড় ডেলিভারি করেন – এমন দর্জি পাওয়া বড়ই দুষ্কর।

যাহোক এমন দুর্মূল্যের বাজারে প্রায় বছর দশেক আগে বনানী মার্কেটে এক নবাগত দর্জি স্বপনের সাথে আমার পরিচয়। আমার ভাবির নির্ধারিত দর্জির সহকারী হিসেবে সে কাজ শুরু করেছে। বয়স সম্ভবত ২০-২২। ওস্তাদ গুলশান-বনানী এলাকার ভাবিদের ব্লাউজ বানানোর জন্য স্বনামধন্য। তার মজুরি আকাশছোঁয়া। মাস্টার-টেইলরের দাপটে স্বপনের কোনো বেইল নাই। সে কেবল হাত পাকানো শুরু করেছে। কাজেই আমার মতো একজন নিরীহ ভাতে-মরা গোছের কাস্টমার পেয়ে সে খুব খুশি।

অন্যদিকে কম খরচে একজন দর্জির সন্ধান পেয়ে আমি আপ্লুত। কাগজে ছবি এঁকে, মাপজোখ লিখে, জামা আর মডেলের ফটো ডাউনলোড করে নিয়মিতভাবে আমি তাকে সবক দেই। এনজিও-তে চাকরি করার সুবাদে অতি আগ্রহে আমি তার ক্যাপাসিটি বিল্ডিং-এর স্ব-আরোপিত দ্বায়িত্বও নিয়ে নিলাম। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে পুরোদস্তুর প্রফেশনাল দর্জি হয়ে উঠলো।
একদিন মোবাইল খুলে আমি একটা জামার ছবি দেখাতেই সে বললো, “আপা, আমাকে ভাইবারে ছবিটা পাঠায় দেন”। আমার অবাক দৃষ্টি দেখে জানালো, কোনো এক ভাবি তাকে ভাইবার ব্যবহার করতে শিখিয়েছেন বিদেশ থেকে কাপড় সেলাই করার নির্দেশনা দেবার জন্য।

দিনে দিনে স্বপনের হাত পাকে, ব্যবসাও বাড়ে। একসময় সে নিজেই মাস্টার, আর সাথে দুই সহযোগী। তবে বহু পুরনো কাষ্টমার হিসেবে আমার কদরের কমতি হয়নি কখনও। আস্তে আস্তে আমি আরো অলস হতে শুরু করলাম। শুধুমাত্র কাপড় তার কাছে পৌঁছুলেই হয়। ডিজাইন করে বানানো হলে আমার ড্রাইভারকে ফোন করে নিয়ে যেতে বলে। আগে বলেছিলাম, আমার চাবুক, থুক্কু ড্রাইভারভাগ্য খুব ভালো। তবে দর্জিভাগ্যও ঈর্ষণীয়!

ঠিক দুবছর আগের এক শীতে আমি দাতা সংস্থার অতিথি নিয়ে ট্যুরে গেছি। বাঙ্গালি আতিথেয়তার আতিশয্যে আমাদের কয়েকজনকে বরাদ্দ করা হলো সার্কিটহাউজের ভিআইপি রুম। সেই ব্রিটিশ আমলের পনের ফুট উঁচু ছাদ, বিশাল কড়িকাঠের দরজা, লাগোয়া বাথরুম আমার বাসার বেডরুমের প্রায় সমান। গা ছমছম করা বিশালতা। শীতের রাতে নয়টা নাগাদ ডিনার শেষে ঘরে ঢুকতেই শিয়ালের ডাক। তড়িঘড়ি করে মশারির ভেতরে গিয়ে ঢুকে চোখ বন্ধ করলাম।

হঠাৎ করে মোবাইল বেজে উঠলো। স্বপনের ফোন। হ্যালো স্বপন? বলতেই ওপাশ থেকে অচেনা কন্ঠস্বর: আমি স্বপন না, আমি একজন ডাক্তার, ধানমন্ডির পপুলার থেকে কথা বলছি। স্বপন মারা গেছে, আমাদের এখানে ইটিটি করার সময়। ওর মোবাইল থেকে আপনাকে ফোন করলাম, লাশ নেবার ব্যবস্থা করেন।
আমি একরাশ আতঙ্ক নিয়ে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কি? প্রায় সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিল। ধড়মড় করে বিছানায় বসে আলো জ্বেলে রিং ব্যাক করলাম, কেউ ফোন রিসিভ করলো না। কয়েক বারের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হঠাৎ নিজের পরনের জামার উপর চোখ পড়লো। স্বপনের বানানো জামা। ও নিজে কাপড় কিনে ডিজাইন দিয়ে বানিয়ে দিয়েছিল!

আতঙ্কে অবশ হয়ে আসছিলাম! আমার দৃশ্যপটে ইটিটি-র টেবিলে ওর মৃতদেহ আর রুমের বাইরে থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের ডাক।

কিছুক্ষণের মধ্যে ভয়ভীতি ছুঁড়ে ফেলে বাসার ড্রাইভারকে ফোন করলাম। বললাম এক্ষুনি বাসায় আমার ছেলের কাছে গিয়ে ওর কাছে যেকটা টাকা আছে সেগুলো নিয়ে সোজা পপুলারে গিয়ে গাড়ি ভাড়া করে লাশ স্বপনের গ্রামের বাড়িতে নেয়ার ব্যবস্থা করতে। শহরে সে একা থাকতো। ফোনে তার সহকারীকে জানালাম যে, স্বপন গুরুতর অসুস্থ, এখনই যেন সে ধানমন্ডির পপুলারে যায়।

খুব অসহায় লাগছে। কোনো শিক্ষিত অথবা ধনী পরিবারের কেউ এই ঘটনার শিকার হলে তা নিয়ে কত তোলপাড় হতো। অথচ প্রায় নামহীন এই খেটে খাওয়া সাধারণ যুবকের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে কোথাও কোনো প্রতিবাদ হবে না, কারো কোনো দায়বদ্ধতা নেই!

নির্ঘুম সময় কাটছে।

মাঝরাতে আপডেট পেলাম, ওকে নিয়ে ওর সহকর্মী গ্রামের বাড়ির পথে রওয়ানা হয়েছে।

এবার ঘুমানোর চেষ্টা করতেই মাথায় আসলো – অন্তত গত এক সপ্তাহে স্বপনের সাথে আমার ফোনে কোনো কথা হয়নি। সুতরাং কল লিস্টে আমার নাম্বার থাকার কথা না। ওর ফোনে আমার নাম হাসিন আপা নামে সেইভ করা। কাজেই ফোন ডিরেক্টরিতে আমার নাম শুরুতে থাকার কথা না। তাহলে ডাক্তার এত নম্বর থাকতে আমাকে ফোন করলেন কেন?
আসলে সে রাতে কে আমাকে ফোন করেছিল?

ফেইসবুক কমেন্ট - Facebook Comments
TAGS

LEAVE A COMMENT