হাসিন জাহান
ঢাকা, বাংলাদেশ

আমি হাসিন। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছেছি জীবনের প্রায় মাঝ বরাবর। পথ চলতে চলতে অনেক কিছু দেখা হয়েছে, জানা হয়েছে, শেখা হয়েছে। অনেক সময় চোখের দেখার বাইরেও অনেক বিষয় অনুধাবন করেছি ভিন্নভাবে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই বোধহয় এক একটা উপন্যাস। আমার জীবনের উপন্যাসের পাতাগুলো থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে ডিজিটাল স্মৃতির খাতায় জমা রাখার জন্য এই ব্লগ। আর তাতে যদি কারো ভালো লাগে, সেটা হবে বাড়তি পাওনা। একটাই জীবন, তাই এর প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠুক আনন্দময় আর আলোকিত!

খোঁজ করুন
খোঁজ করুন
জীবন যেখানে যেমন

আমার মাষ্টারপিস রান্না

on
March 2, 2019

রান্নাবান্নায় আমার আগ্রহ সাংঘাতিক। ইউটিউবে রান্না দেখতে বড়ই ভালোবাসি। টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান, পত্রিকার পাতায় রান্নার বর্ণনা, কোনোটাই বাদ যায় না। সমস্যা একটাই, শুধু রান্নাটা কখনো করা হয় না, এই যা!

প্রথম জীবনে মা আর পরবর্তীতে শাশুড়ির কেয়ার অফ-এ থেকে, আর ক্ষিদে লাগলেই টেবিলের উপর খাবার পেতে পেতে, আমার রান্নাটাই কখনো শেখা হয় নাই।

যাইহোক, রান্না নিয়ে আমার স্ট্রাগল শুরু হয় প্রায় বছর তিনেক আগে, যখন থেকে তিনকূলে আমাকে আর রান্না করে খাওয়ানোর কেউ নেই!

ভাবলাম ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতিতেই রান্নার প্র‍্যাকটিস শুরু করবো।খুবই সহজ, ইউটিউবে রেসিপি খুঁজে পাওয়া কোনো ব্যাপার না! কিন্তু বিপত্তি হয় যখন ইউটিউবে সার্চ করে রান্না শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যে টাচস্ক্রিনে হাত লেগে ভিডিওটা গায়েব হয়ে যায় বা অন্য ভিডিও চালু হয়। ভিডিও খুঁজতে গিয়ে ‘কূল রাখি না মান রাখি’ করতে গিয়ে রান্নার বারোটা।

অতঃপর ডিজিটাল পদ্ধতি বাদ দিয়ে ম্যানুয়ালে গেলাম, অর্থাৎ লিখন ও পঠন পদ্ধতি অবলম্বন করলাম। নানা উপায়ে রেসিপি সংগ্রহ করে এবং তার পরিমাণ লিখে নিয়ে, সেটা দেখে দেখে রান্না। কিন্তু রান্না করতে গিয়ে গুনে গুনে ১০-১২টা গোলমরিচ, ৮-১০ এলাচি, তিন চামুচ তেল – এসব গোনাগুনতি আর মাপামাপি করতে গিয়ে খুব দ্রুতই ধৈর্য হারালাম।

এরপরে শুরু করলাম ‘র‍্যান্ডম মেথড’। এটা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং নির্ভেজাল পদ্ধতি। এখানে ক্রিয়েটিভিটি আর ডিসিশন মেকিং দুটোরই সমন্বয় থাকে। অর্থাৎ ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’র মতো ‘যেমন খুশি তেমন রাঁধো।’

এই পদ্ধতির সুবিধে হলো, আমার প্রতিটা রান্নাই হয় এক একটা মাস্টার পিস! কারণ একবার যেটা রান্না করি, উপকরণগুলোর পরিমাণ এবং পদ্ধতি মনে না থাকায়, পরের বার সেই একই পদ স্বাদে-গন্ধে-বর্ণে একেবারে নতুন হয়!

তবে এই পদ্ধতির সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো, এর ট্রায়ালের ক্ষেত্রে টেস্টার বা গিনিপিগ পাওয়া সহজ না!

ঘরের শত্রু বিভীষণ! বড় ছেলে স্পষ্ট করে বললো, ‘তোমার রান্না মুখে দেওয়া যায় না। এত কষ্ট করে আর রান্নার চেষ্টা করো না।’ ছোট ছেলে নেহায়েতই নিরীহ গোছের। সে করুণ কণ্ঠে বলল, ‘তুমি তো অনেক কাজই করতে পারো, রান্না না পারলে অসুবিধা নাই। সবাইকে দিয়ে তো আর সবকিছু হয় না!’ কিন্তু আমি দমবার পাত্র না। হিটলার স্ট্র্যাটিজিতে নিজের রান্না করা খাবারের প্রশংসা নিজেই করতে শুরু করলাম – সেল্ফ মার্কেটিং আর কি! কিন্তু হিতে বিপরীত। খাবারের প্রশংসা শোনামাত্র বড় ছেলে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কোনটা রেঁধেছো? তারপর আমি যেটা রান্না করেছি, আতঙ্কে ওটা বাদ দিয়ে অন্য পদ দিয়ে খেয়ে ওঠে।’ ছোট ছেলে মুখবুঁজে খেয়ে সরু গলায় বলে, ‘খাওয়া তো যাচ্ছে!’

অতএব এবার অন্য পথ ধরলাম – মাঝেমধ্যে জুনিয়র অথবা পোলাপাইন-কিসিমদেরকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো শুরু করলাম। পাশাপাশি বিদেশ থেকে বন্ধুরা ছুটিতে দেশে আসলে রেস্টুরেন্টে যাবার পরিবর্তে রান্না করে খাওয়াই। যাতে অন্তত আমার প্রাক্টিসটা জারি থাকে। তবে দাওয়াত খেতে আসা অনেকে ভদ্রতার খাতিরে প্রশংসা না করে পারেন না। আবার অনেকে চক্ষুলজ্জা থাকলেও সঙ্গত কারণে ততটা জোর করে প্রশংসা করতে পারেন না। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন – হিমেল, আমার ননদের ছেলে, আমি যা রাঁধি নির্দ্বিধায় খেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। যারা আমার ফ্যান এবং এসি (এই প্রসঙ্গে পরে কোনো এক সময় লিখবো), অর্থাৎ আমাকে যারা কমবেশি পছন্দ করেন, তারা আমার উৎসাহ ধরে রাখার জন্য মানবিক কারণেই অনেকটা জোর করে ভালো বলেন।

একবার জীবনে প্রথমবারের মতো আইড়মাছ রাঁধবো বলে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। আমার রান্নার হাতযশের ব্যাপারটা অনেকেরই জানা। তাই তারা নানান পরামর্শ আর উপদেশ-বাণী দিতে থাকলেন। আমার তখন অতশত শোনার সময় নেই! রান্না শেষ করে যখন ফেসবুক খুললাম, দেখি শুভানুধ্যায়ীদের অনেকগুলো কমেন্টের মাঝে ভোজনরসিক আমার প্রাক্তন বস লিখেছেন, ‘ক্যাট-ফিস জাতীয় মাছ না ভেজে রাঁধতে হয়। রান্না শেষে ধনেপাতা দিবেন না, জিরা দিয়েন।’ আমি মোটামুটি নির্বাক। কমেন্টের ঘরে লিখলাম রান্নার সময়ে মাছ যেন না ভাঙে সেজন্য আচ্ছামতো ভাজি করছি। রান্না শেষে জিরা দিব, নাকি ধনেপাতা দিব – সিদ্ধান্ত না নিতে পেরে শেষ পর্যন্ত দুটোই দিয়েছি। বুঝুন এবার আমার র‍্যান্ডম মেথডে মাষ্টারপিস রান্নার অবস্থা!

যাহোক চেষ্টা আর অধ্যবসায় রবার্ট ব্রুসের প্রায় কাছাকাছি চলে গেলাম। আমি নব নব উদ্যমে রান্না করে যাই। হঠাৎ একসময় আবিষ্কার করলাম আমার দু-একটা আইটেম কনসিস্টেন্টলি ভালো হতে শুরু করেছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে, কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে আমি #75persons চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেললাম – অফিসের সবাইকে পহেলা বৈশাখে রান্না করে খাওয়াবো!

শুনে আমার ছেলে বলল, ‘একি করছো? এতগুলো মানুষকে গিনিপিগ বানাবে?’ বললাম, ‘এভাবে বলতে হয় না।’ ছেলে করুণ সুরে বলল, ‘তুমি তাদের বস। তুমি ভয়াবহ রান্না করলে কি উনারা খারাপ বলতে পারবেন?’ বললাম, ‘কেন পারবে না?’ তবে মনে মনে প্রমাদ গুনলাম – তীর তো ছুঁড়েই ফেলেছি, আর ফেরানোর উপায় নেই।

শেষতক আমি পয়লা বৈশাখে সবার জন্য রান্না করে অফিসে হাজির হয়েছিলাম। তবে এতে সামান্য কিছু কৌশল ছিল। যেমন নানা পদের ভর্তা। গোপনে বলে রাখি: মাছ আর বেগুন ভাজি করতে গিয়ে ভেঙে ছেড়াবেড়া হয়ে যাওয়ায় দুটোরই ভর্তা বানিয়ে ফেলেছি, ব্যস! তবে হিট করলো নকল পান্তাভাত – গরম ভাতের সাথে লেবু-মরিচ-পেয়াজ- লবণ ডলে দিয়ে ফ্রিজের পানি ঢেলে তৈরি করা। আপনারাও করে খেতে পারেন, ভালো লাগবে!

এত কিছুর পরেও রাঁধুনি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া খুব একটা সহজ হচ্ছে না। খাওয়ার পরপরই দাওয়াতিরা সুযোগ মতো আমার হোম ম্যানেজারকে জিজ্ঞেসাবাদ করে নিশ্চিত হতে চায়, আসলেও আমি রেঁধেছি কিনা। একদিন এক দাওয়াতি সুকৌশলে আমার হোম ম্যানেজারকে লিডিং কোশ্চেন না করে বললো, ‘নাসিমা আপা, আপনারা রান্না খুব মজা হয়েছে। সেও স্মার্টলি উত্তর দিল, থ্যাঙ্ক ইউ!’ সাথে সাথেই আমি ভূয়া ক্রেডিট দাবি করছি ভেবে সবাই আমার উপর চড়াও হলো। আবার অনেকেই আমাকে তীব্র সন্দেহ করেন। তাদের ধারণা আমি আসলে রাঁধতে জানি, কিন্তু রান্না করতে হবে ভেবে বিষয়টা গোপন রাখি!

এবার ঠিক করলাম, ছোট ছেলেকে রান্নার ছবক দেব। যথেষ্ঠ বড় হয়েছে, কাজেই রান্নাবান্না শেখা দরকার। আমি যে ভুল করেছি, অন্তত আমার ছেলে যেন সেই একই ভুল না করে। ছেলেও খুব আগ্রহ নিয়ে আমার কাছে মুরগি রান্না শিখতে আসলো। আমি সিদ্দিকা কবিরের স্টাইলে মহা আয়োজন ডেমনেস্ট্রেশন আর রানিং কমেন্ট্রি দিয়ে যাচ্ছি। বললাম: প্রথম হাঁড়িতে তেল আর পেঁয়াজ দিতে হবে। ছেলে বললো: কতটুকু? বললাম, আন্দাজ মতো। তারপরে আদা, রসুন, মরিচ-হলুদ দিতে হবে। ছেলে জিজ্ঞেস করে: কতটুকু? আমি বললাম, আন্দাজমতো। তারপর গরম মশলা দিয়ে কষিয়ে পানি। ছেলে বললো: কতটুকু? আমি বললাম: আন্দাজ মতো। রান্না শেষ হলো। ছেলেকে গর্বিত ভংগীতে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিকমতো শিখেছ তো? উত্তরে বলল শিখেছি, তবে তুমি তো সবই আন্দাজমতো দিতে বললে। এই আন্দাজটা যে কতটুকু, সেটাই তো বুঝতে পারলাম না। শোনার পরে আর আমি কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ওর সামনে থেকে আস্তে করে সটকে পড়লাম!

ফেইসবুক কমেন্ট - Facebook Comments
TAGS
4 Comments
  1. Reply

    Tanvir

    March 3, 2019

    সাবাশ আপা!!! সাবাশ! এরকম কারো তোয়াক্কা না করেই কেকা আজ এতদূর! হবে হবে…. আপনারও হবে!

    • Reply

      Hasin

      July 3, 2019

      আমিও বড় হয়ে একদিন কেকা আপা হবো! 😛

  2. Reply

    Engr Md Iqbal Kabir

    March 7, 2019

    অসাধারণ লেখনী।

    • Reply

      Hasin

      July 3, 2019

      ধন্যবাদ!

LEAVE A COMMENT