আমার বয়স্কশিক্ষা
মনে নেই কোন মাহেন্দ্রক্ষণে আমার পুরোনো এক সহকর্মীকে কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলাম: আবারও ইউনিভার্সিটিতে পড়তে ইচ্ছে করে! শুনে বলেছিল: পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করতে পারেন। কথার পিঠে কথা হিসেবে আমিও বলেছিলাম: তুমি পড়লে সাথে নিও। ওমা আর যায় কোথায়! গেল মে-তে এসে খবর দিল: আপা, আপনার জন্য ফরম নিয়ে এসেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনিস্টিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ভালনারিবিলিটি স্টাডিজ’-এর ডিপ্লোমা কোর্স। ছয় মাসের, তবে শুধুমাত্র ছুটির দিনে। আপনি তো বলেছিলেন, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে আপনার আগ্রহ আছে!
মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। নিজের ফাঁদে নিজেই ফেঁসেছি! বললাম: আরেকটু ভেবে দেখি।
আমার ছোট ছেলের সাথে বিষয়টা নিয়ে একান্তে পরামর্শ করলাম – আমি কী শেষ করতে পারবো? যদি পাশ না করি, তবে লোকজন কী খুব বেশি হাসাহাসি করবে? আরো কতো কী! এক পর্যায়ে সে রীতিমতো প্রোবিং প্রশ্ন করে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করলো। প্রশ্নোত্তর শেষে সে সারসংক্ষেপ করলো: তুমি তো আসলে পড়াশোনা করে, পাশ করতে চাও না। তুমি কিছুটা ভালো সময় কাটাতে চাও, আর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট নিয়ে একাডেমিক ধারণা পেতে চাও, যাতে প্রফেশনালি তোমার কাজে লাগে। আমি বললাম: হ্যাঁ। তখন সে উপসংহার টানলো: তাহলে ভর্তি হয়ে যাও!
শুরু হলো আমার প্রস্তুতি। এর অংশ হিসেবে প্রথমেই মাথার চুল কান পর্যন্ত ববছাঁট দিয়ে ফেললাম, যাতে চট করে কেউ আমাকে চিনতে না পারে। ছাত্রছাত্রী না, বরং শিক্ষকমহলকে মাথায় রেখেই এই ছদ্মবেশ। আমার সাথে সাথে আমার হোম ম্যানেজারেরও উৎসাহের কমতি নেই। ইউনভার্সিটিতে যাবার জন্য রেডি হবার সময় সে কোত্থেকে যেন বিশালাকৃতির একজোড়া কানের রিং নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল: এইডা পরেন, সিনেমার ভিতরে মাইয়ারা এইরকম রিং পইরা ইনভার্সিটিতে যায়! আমি কথা না বাড়িয়ে, রিং দুটো পরে ফেললাম। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে গেলাম সোজা ইউনিভার্সিটি। ক্লাসমেট হিসেবে পেলাম পুরনো দুই সহকর্মীকে। জেন্টেল(ও)ম্যান এগ্রিমেন্ট হিসেবে সিদ্ধান্ত নিলাম – কেউ কারো পরিচয় বা কারো অফিস সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আলাপ করবো না, আমাদের একটাই পরিচয় আমরা সহপাঠী।
সামনের সারিতে বসে পা দোলাতে দোলাতে প্রথম ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাস নিতে আসলেন ডক্টর সালিমুল হক ভাই। আমি ওনাকে না চেনার ভান করে খাতা-কলম নাড়াচাড়া করতে থাকলাম। উনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ক্লাস নিতে শুরু করলেন। আমার নতুন হেয়ারকাট, সাথে বাংলা সিনেমার নায়িকাসুলভ গেট-আপের আড়ালে উনি আমাকে চেনেন নাই বলে আমি মনে মনে বেশ আশ্বস্ত হলাম।
কিন্তু ব্রেক থেকে ফিরে উনার দ্বিতীয় লেকচার শুরু করার আগেই আমাকে সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: ভালো আছেন হাসিন? লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল আরকি! অপরাধীর দৃষ্টি নিয়ে হড়বড় করে কী যেন বলার চেষ্টা করলাম। তবে আমার অনুমান, উনি প্রথমে আমাকে দেখে কিছুটা হোঁচট খেয়েছিলেন। ব্রেকের সময় হয়তো হাজিরা খাতায় আমার নাম দেখে নিশ্চিত হয়ে তবেই আমার সাথে কথা বলেছেন।
যাহোক, এত বছর পরে ক্লাস করতে এসে কী যে ভালো লাগলো! নাহ্, ঠিক পড়তে না, ক্লাসের আগে-পরে আর ব্রেকের সময় দৌড়ে গিয়ে ক্যান্টিনে খাওয়া-দাওয়া করতে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দল ভারি হতে লাগলো। সবার সাথে আড্ডা আর গল্পে কী যে আনন্দ! আমি শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকি, নাকে-মুখে দুপুরের খাবার খেয়ে কতক্ষণে ইউনিভার্সিটিতে যাব!
কোর্স কো-অর্ডিনেটর ম্যাডাম – বড়ই কঠিন! তবে উনিই ছিলেন আমাদের আবদার আর দাবি আদায়ের একমাত্র ভরসা। শুরুর দিকের কোনো একদিন, ক্লাসের কেউ একজন মুখ ফসকে তাকে আপা বলে ফেলেছিলেন। আর যায় কোথায়! উনি মহা খেপে গিয়ে বললেন: আপা ডাকলেন কেন? আমি কী এনজিওতে চাকরি করি? আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকবেন। আড়চোখে দেখলাম আমার প্রাক্তন সহকর্মী করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো ভাবছিলেন আমি বুঝি রণ(স্ব)মূর্তি ধারণ করি! কিন্তু আমি কী আর সেই ভুল করি! আমি তো তখন নেহায়েতই ইউনিভার্সিটি-গোয়িং গোবেচারা এক ছাত্রী! পেটফেটে হাসি পেলেও চেপে গেলাম। তারপর থেকে আড়ালে আবডালে অনেকেই মাঝে মধ্যে তাকে আপা ডাকলেও সামনে কখনই কারো ম্যাডাম ডাকতে ভুল হয়নি।
আমার এই বয়স্কশিক্ষা কার্যক্রম শেষ করতে পারবো কিনা সেটা নিয়ে সবার মতো আমারও যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। দু-চারজন ছাড়া বিষয়টি কেউ বিশেষ জানতো না। আর যারা জানতো তারা কেউ কেউ মুখ টিপে হেসে, আবার কেউ কেউ প্রকাশ্যেই দুঃখ প্রকাশ করেছে যে- খামাখাই আমি টাকাটা জলে ফেললাম!
বাসায় ড্রাইভার সাধারণত শুক্রবারে আমাকে ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যেত। প্রথম প্রথম সে ভেবেছে, আমি হয়তো ক্লাস নিতে যাই। কিন্তু আমার চলাফেরা আর কথাবার্তায় অনুমান করেছে, বিষয়টা ঠিক তা না। একদিন গাড়িতে উঠতেই সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো: আপা, আপনি কী ইউনিভার্সিটিতে পড়ান? আমি বললাম: না, আমি তো ভর্তি হয়েছি, পড়তে যাই! শুনে হতাশ কন্ঠে বললো: এই বয়সে আর পড়াশোনা কইরা কী করবেন? আমি তো হতবাক! আমি তাকে নানা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম- পড়াশোনার কোনো বয়স নাই, যেকোনো বয়সে করা যায়। আমার কথায় সে মোটেও কনভিন্সন্ড হলো না। শেষ পর্যন্ত বিরসবদনে নিরস কন্ঠে বললো: খামাখা ট্যাকাডি নষ্ট করতাছেন। আমি ততক্ষণে অধিক শোকে পাথর!
টানা চারটা ক্লাস প্রতি শুক্রবার। বাড়ি ফিরতে সেই রাত নয়টা! তবে যে যাই বলুক, আমার মন পড়ে থাকে শুক্রবারে। ছোটবেলার মতো একসাথে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া-আসা, গ্রুপওয়ার্ক-প্রজেন্টেশনের প্যারা, পাশাপাশি নতুন নতুন বন্ধু, হালের ফ্যাশন আর জামাকাপড়ের সন্ধান, নিজেদের আলোচনার সুবিধের জন্য খোলা মেসেঞ্জারে রাতবিরেতে খুনসুটি, কে ক্লাসে কী বললো সেসব নিয়ে কথা চালাচালি, আরো কত কী!
দেখতে দেখতে পরীক্ষার তারিখ পড়লো। ঠিক প্রায় একই সময়ে আমার বিদেশে ট্যুর। যেদিন দেশে ফিরব, তার পরদিনই পরীক্ষা। অগত্যা সারারাস্তায় ছোটবেলার মতো নাইট-ফাইট দেয়া আরকি! রাস্তায়, ট্রানজিটে, প্লেনের ভেতর রীতিমতো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছি। লক্ষ্য করলাম, লোকজন ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তাতে আমার কী-ই-বা এলো গেল! যাহোক, জেটল্যাগ, ক্লান্তি সবকিছু ভুলে পরীক্ষার খাতায় লিখতে বসেছি। টার্গেট একটাই – হাতের লেখায় ৫ নম্বর আমার চাই-ই। সারা জীবনে পাইনি তো কী হয়েছে! এবার পেতেই হবে। ওমা, সবাই দেখি একস্ট্রা পাতা নিয়েই যাচ্ছে! আর আমি মূল খাতা নিয়েই শেষ পর্যন্ত বসে আছি! পরীক্ষা শেষে সবার তুমুল আলোচনা, কে কেমন পরীক্ষা দিয়েছে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলেছি, হাতের লেখার পূর্ণমান ৫ আমার থাকবেই, এতে কোনো সন্দেহ নাই। তবে, আসল কথা, কিবোর্ডে লিখে লিখে কী আর হাতে লেখা আগায়!
আরেকদিন লেকচার থিয়েটার-এর সামনে মুখোমুখি হলাম বুয়েটের ক্লাসমেট ডক্টর সালেহীন এর সাথে। ও আমাদের ক্লাস নিতে এসেছে। জিজ্ঞেস করল: তুমি এখানে? আমি করুণভাবে বললাম: তুমি লেকচার দিবে জেনে, শুনতে আসলাম। আমার কথাতেই বুঝে নিল ঘটনা কী! মহাবিড়ম্বনায় পড়লাম যখন সারা ক্লাসে ও কিছুক্ষণ পর পর জানান দিতে থাকলো, যে আমি ওর সাথে পড়তাম, এ বিষয়ে আমি ভালো জানি ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আমি লজ্জায় মরি মরি। পুরোটা কোর্সে চেনা আরো কয়েকজনে সাথে দেখা হয়েছে যারা আমার ছদ্মবেশ ধরতে পারেনি। আবার কারো কারো ক্লাস মিসও করেছি।
অতঃপর শেষ পরীক্ষা! তবে সেবারেও একই দশা, প্লেন থেকে নেমে পরদিন পরীক্ষা দিতে গেলাম। বাকি রইল ফিল্ডভিজিট করে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া। সবাই মিলে একসাথে ম্যাডাম-এর নেতৃত্বে মাইক্রোবাসে চেপে মজা করতে করতে গেলাম ফিল্ডভিজিটে। সবাই যে কী সিরিয়াস! আর আমি প্রায় পুরো অ্যাসাইনমেন্টটাই মোবাইলে লিখলাম। ঠিক যেমন ট্রাফিক জ্যামে বসে ব্লগ লিখি। যেদিন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিলাম, সেদিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! যাক, আর লেখাপড়া করতে হবে না। তবে পরক্ষণেই মন খারাপ হলো, আর তো ইউনিভার্সিটি যাওয়া হবে না! নতুন স্টুডেন্ট আইডি, পিঠে ঝোলানো ব্যাগ, পায়ে কেডস পরে মধুর ক্যান্টিনের সামনে আড্ডা, টিচাররাদেরকে নিয়ে খুনসুটি- আর হবে না!
তবে স্মৃতি তুমি বেদনা হয়ে রয়ে গেল আমাদের ম্যাসেঞ্জারের চ্যাটবক্স। মাঝেমাঝেই সেখানে চলে টুকটাক কথোপকথন।
গতরাতে সেখানেই পেলাম আমাদের রেজাল্টশিট। যারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে, তাদের মুখে চুনকালি, থুক্কু ফুলচন্দন দিয়ে আমি ঠিকই পাস করেছি। জীবনে প্রথমবারের মতো সিজিপিএ পেলাম, সেটাও খারাপ না। মানির মান আল্লাহ রাখে, শেষ অব্দি পড়াটা শেষ করে করতে পেরেছি তাতেই আমি মহা খুশি। তবে মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, যারা ‘পাশ করবো না’ বলে বেশি বেশি গলা শুকাতো, তারাই কিন্তু সবচেয়ে ভালো করেছে। ভালো ছাত্রছাত্রীদের যেমন সবসময় পরীক্ষা খারাপ হয়, আর গান গাইতে বললেই যেমন গায়ক-গায়িকাদের গলা, ঠিক সেরকম।
কৃতজ্ঞতা জানাই আমার সব সহপাঠীদেরকে যাদের সাথে পুরোটা সময় উপভোগ করেছি। ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ দুজনের চেষ্টা ছিল তুলনাহীন। জেন্টেল(ও)মেন এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী আমার পুরোনো সহকর্মীদের নাম প্রকাশ করলাম না। তবে তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই সহকর্মী আর সহপাঠী হিসেবে দ্বৈত ভূমিকায় সফলভাবে প্রফেশনালি সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য। চোখের পলকে কেটে গেল ছটা মাস। তবে রয়ে গেল কিছু চমৎকার স্মৃতি, আর চমৎকার কিছু মানুষ- এটা কী কম পাওয়া!
দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমি অনেকদিন ধরেই কাজ করি, বিভিন্ন ফোরামে কথাও বলি। তবে এ নিয়ে আমার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পড়াশোনা ছিল না। যেকোনো বিষয়েরই কিছু নিজস্ব ল্যাংগুয়েজ থাকে। সেটা জানতে হলে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, কোথায় কী আছে, সেটা খুব ভালোভাবে জানা যায়। আর বাকিটা তো নিজের উপর। যেকোনো পড়াশোনাই মানুষের আত্মবিশ্বাসের পাল্লাটা ভারি করে। আসলে জানার কোনো শেষ নাই। আর পড়ার জন্য বয়সের কোনো সীমাও নাই, শুধু ইচ্ছেটাই যথেষ্ট।
পড়াশোনা করতে গিয়ে নতুন অনেক কিছু জানার পাশাপাশি এখনকার সময়ে ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকদের পড়ানোর মান, পদ্ধতি এবং আন্তরিকতার গভীরতা কিছুটা হলেও অনুমান করেছি। ভালো-খারাপ দু’ধরনের অভিজ্ঞতাই আছে। পড়ানোর গুণগত মান উন্নত করার অনেক সুযোগ আছে। কোন কোন শিক্ষকদের মাঝে অনেক সময় উদারতার অভাব অথবা আত্মপ্রচারের দৃষ্টিকটু প্রচেষ্টা নজরে পড়েছে। ভালো লেগেছে অনেক শিক্ষকের শেখানোর জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখে। পুরো কোর্সে সবচেয়ে ভালো লেগেছে প্রফেসর মোহাম্মদ আমির হোসেনের পড়ানো। উনার ক্লাস শেষে মনে হয়েছে: আজ থেকে ২৫ বছর আগে যদি আমি উনার ক্লাস করতাম, তবে আমি আজ হয়তো একজন স্টাটিস্টিশিয়ান হতাম!
ফেইসবুক কমেন্ট - Facebook Comments