হাসিন জাহান
ঢাকা, বাংলাদেশ

আমি হাসিন। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছেছি জীবনের প্রায় মাঝ বরাবর। পথ চলতে চলতে অনেক কিছু দেখা হয়েছে, জানা হয়েছে, শেখা হয়েছে। অনেক সময় চোখের দেখার বাইরেও অনেক বিষয় অনুধাবন করেছি ভিন্নভাবে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই বোধহয় এক একটা উপন্যাস। আমার জীবনের উপন্যাসের পাতাগুলো থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে ডিজিটাল স্মৃতির খাতায় জমা রাখার জন্য এই ব্লগ। আর তাতে যদি কারো ভালো লাগে, সেটা হবে বাড়তি পাওনা। একটাই জীবন, তাই এর প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠুক আনন্দময় আর আলোকিত!

খোঁজ করুন
খোঁজ করুন
জীবন যেখানে যেমন

আমার বুয়েট-জীবন

on
November 13, 2018

সাতসকালে আমার সহপাঠী মাহফিলের কাছ থেকে মেসেঞ্জারে রিকোয়েস্ট পাই- বুয়েটের সিলভার জুবিলির পাবলিকেশনে যেন অবশ্যই ‘বুয়েট-জীবন’ নিয়ে একটা কিছু লিখি। সেই সূত্রেই এই লেখা।

আমার বুয়েট-জীবন সহপাঠী আর দশটা ছেলেমেয়ের মতো ছিল না। কারণ আমার এই জীবনের শুরুটাই ছিল অন্য রকম। অনেকেই আমার বয়স নিয়ে প্রশ্ন করেন । দাদী হয়ে গেছি, এতেও বিস্ময় । কারণ হয়তো অনেকেই জানেন না। আমার বিয়ে হয় ১৭ বছরে। প্রথম সন্তান ১৮ তে। আর ছাড়াছাড়ি ১৯ বছরে। অনেকটা ভিনি-ভিডি-ভিসি আরকি। সুতরাং আমার বুয়েটযাত্রা শুরু হয় কয়েক মাসের ছেলেকে নিয়ে।

আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে ডিভোর্স বিষয়টা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কাজেই অনেক সময় আমার ভেতরও একটা দলছুট অনুভব ছিল। আবার কখনও কখনও এক ধরনের লজ্জাবোধের ভেতর দিয়ে যেতাম। মনে হতো আমার খুব কাছের বান্ধবীরা হয়তো আমাকে নিয়ে অন্য রকম কিছু ভাবছে। সংকোচ ছিল নিজের মধ্যেই। নিজেকে অনেকটা এলিয়েন মনে হতো। ডালিয়া, শারমিন, নাহিদ, ইমা, সাবিনা, মানসী ছিল আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। বাকিদের সাথে ক্লাসের ফাঁক-ফোকরে দেখা-সাক্ষাৎ। তখন বুঝিনি, তবে পরে বুঝেছি তারা কত মানবিক ছিল! আমার জীবনের ঘটে যাওয়া এই মুখরোচক বিষয়টি নিয়ে তারা বাজার-চাউর করেনি। আমি তাদের সবার কাছে নিঃশর্ত ও নিঃস্বত্বভাবে কৃতজ্ঞ।

ধরে নিয়েছিলাম আমার জীবনটাকে সামনে নিতে গেলে অন্তত পাশটুকু করতে হবে। শুধু এটাই ছিল প্রত্যাশা। নিজেকে তখন ‘মেয়ে’ মনে হয়নি, জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ একজন মানুষ মনে হতো। কাজেই, ছেলে বন্ধুদের সাথেও আমি ছিলাম একই রকম সহজ ও স্বচ্ছন্দ।

আমার রিডিং-পার্টনার হিসেবে সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল রেজাউল। আমাদের রোল নম্বর ছিল পাশাপাশি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা পাশাপাশিই ছিলাম। স্বপন বৈদ্য আরেকজন- আমরা ছিলাম একে অন্যের কথা জমা রাখার ব্যাংক! ইকো ছিল আমার ল্যাব-পার্টনার। একবার ল্যাব রিপোর্ট কপি করায় সবাই যে ‘বাপের নাম ভুলানো’ ঝাড়ি খাইলাম তা ভোলার না! ফিরোজ শামস আমার ভাইয়ের মেয়েকে পড়াতো। সেই বুয়েট থেকে সাইকেল চালিয়ে মোহাম্মদপুরের বাসায় আসতো ঘেমেনেয়ে। পড়ানোর পর দুই জন বসতাম ক্লান্তিহীন গল্প নিয়ে। সাথে আম্মার বরাদ্দ নাস্তা। কী নিশ্চিন্ত জীবন!

সে সময়ে মেয়েরা ছেলেদেরকে তুই বলতে দ্বিধান্বিত থাকতো। ক্যাফেতে যেতেও। আমার ভাবনায় যেহেতু ছেলে-মেয়ের বিভেদ নেহায়েতই তুচ্ছ, তাই আমার কোনো অসুবিধা ছিল না। অনেকের সাথেই ছিল অতিসহজ, ‘তুই-তুকারি’ সম্পর্ক। প্রায় দিনই সকালের প্রথম ক্লাসটা ‘বাংক’ মেরে গেটের (এখন যেটা বন্ধ হয়ে গেছে) বাইরে টং-এর বেঞ্চে রেজাউলের সাথে পা ঝুলিয়ে বসে, চায়ের ভেতর বিশালাকার ওভালটিন বিস্কুট দিয়ে ভিজিয়ে খেতাম! আহ কি অপূর্ব স্বাদ! কাছের বন্ধু ছিল আরো অনেকে- রফিক, রানা, আজাদ, রিপন, শিহাব, জাভেদ বারি, রফিক (মোটা), লিংকন, আবেদ- কত জনের নাম বলবো! একদিন রাতারাতি আবেদ দাড়ি রেখে হুজুর বনে গেল। জানি না ওর সাথে আর কোনদিন দেখা হবে কিনা!

আমার পরীক্ষার প্রথম সেমিস্টারের নম্বর ছিল মাত্র ৫৫%। ওখান থেকে হয়তো আরো নিচের দিকেই নামতে থাকতাম, যদি না রেজাউল আর স্বপন পাশে থাকতো! আনামের (আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয়, মেধার জগতে এক বিস্ময়) চোথা যোগাড় করা, সেটা বুঝতে সাহায্য করা। এমনকি আমার সুবিধার জন্য ওরা পালা করে বাসায়ও আসতো। আমার আব্বা যতদিন বেঁচে ছিলেন, তার সাথে আমার স্বপনকে নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হতো। বিষয়টা ছিল- ও আমার বন্ধু, না আব্বার?

আমার কয়েক মাসের বাচ্চা বড় হতে থাকলো। পাশাপাশি তাকে নিয়ে কোটকাচারির ল্যাঠা সামলানো, মানসিক চাপ, আব্বার ক্যান্সার ধরা পড়া, আমার সেকেন্ড ইয়ারে থাকতেই উনার মারা যাওয়া, মাত্র বাইশ বছর বয়সে সংসারের হাল ধরা, আরো কত কি!

মনে আছে রফিক আর স্বপন সারাদিন ধরে কাগজ কেটে আমার ছেলের প্রথম জন্মদিনে ঘর সাজিয়েছিল। তোমরা পাশে ছিলে বলে আমার জীবনটা বোধ হয় এত সহজ ছিল। সেই ৫৫% নম্বর বাড়তে বাড়তে শেষ সেমিস্টারে এসে প্রথম ২৫ জনের লিষ্টে আসলো! তোমাদেরকে ধন্যবাদ জানানোর দুঃসাহস কী আমার আছে?

‘মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়’- অনেকের সাথেই দীর্ঘদিন নানা কারণে যোগাযোগ ছিল না। আবার দেখাসাক্ষাৎ শুরু হলো বুয়েটের রি-ইউনিয়ানে যাতায়াতের সুবাদে। এক সময়ের কাছের বন্ধুগুলো তখন অনেক দূরে – নানা দেশে, আর দূরের বন্ধুগুলো ক্রমশ আরো কাছের বন্ধু হয়ে উঠলো। রফিক (প্রেসিডেন্ট), নাভেদ, নাজ, এনি, ফোরকান, চঞ্চল, মুসা, সোহেল (কাউয়া), তারিক, মঞ্জু, শাহীন- আরো কত জন। এর মাঝে ফেসবুকের কল্যাণে ফিরে পেলাম কত নতুন-পুরনো বন্ধু! ফেসবুকিয় ঘটক গাজী, বিউটি, শেলী, হামিম, হুমায়ুন, সাব্বির- আরো অনেকে। মজার ব্যাপার হলো, এখন আর কাউকে আলাদা করতে পারি না। সবাই এত কাছের আর আপন!

আজ যে কথাগুলো এত সহজে বলতে পারছি, আগে পারিনি। সম্ভবত বয়স মানুষকে স্বাধীনতা দেয়। এখন কত সহজে তোমাদেরকে কত ‘না বলা কথা’ বলতে পারি!

আমার জীবনে অসাধ্য সাধনে যারা আমার পাশে থেকেছো তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা বা শব্দ কোনোটাই আমার জানা নেই। এখনও অনেকের নাম লেখা হলো না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এখন থাক। দেখা হবে খুব শীঘ্রই!

ফোরাম ৮৬ রিইউনয়ন, এরিজোনা

ফেইসবুক কমেন্ট - Facebook Comments
TAGS
2 Comments
  1. Reply

    M Abdul Hye

    November 14, 2018

    Good.Inspirational as well as encouraging with a sad point that takes back-seat on passage of time.Merit matters.Bravo.

    • Reply

      hasin

      December 14, 2018

      Thanks for your comment!

LEAVE A COMMENT