আমরা কি প্রস্তুত?
যখন ছোট ছিলাম, তখন বিদেশে যাওয়াটা ছিল একটা বিশাল ব্যাপার। হামেশাই পত্রিকার পাতায় দেখাতাম, ‘সময়ের অভাবে দেখা করতে না পারায় সকলের কাছে দোয়াপ্রার্থী’। সাধারণত বড় ধরনের চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীরা তখন বিদেশে যাতায়াত করতেন। আর যারা ছাত্র, তাদের জন্য এটা ছিল এক বিশাল ফ্যাকড়া – আইএলটিএস, টোফেল, জিআরই, আরো কত কী! স্কলারশিপ ছাড়া বিদেশ যাওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাও ছিল গ্রাজুয়েশনের পরে। আর বিদেশে বেড়াতে যাওয়া তো ছিল রীতিমতো কল্পনাবিলাস!
এখন দিন বদলেছে। আজকাল আমরা অনেকেই ছেলেমেয়েদেরকে বিদেশে পড়তে পাঠাই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেল্ফ ফাইনান্সে। অনেক সময় দেখা যায় আন্ডারগ্রেড লেভেলেই অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদেরকে বিদেশে পাঠাচ্ছেন। পড়ালেখা শেষে এদের একটা বড় অংশই সেখানে রয়ে যাচ্ছে। আবার কখনও বা ছেলেমেয়েদেরকে বিদেশে সেটেল্ড করতে মা-বাবা নিজেরাই যাযাবর হচ্ছেন!
আমার আজকের লেখার বিষয় মেধা পাচার, দেশাত্মবোধ বা এসবের ভালোমন্দের বিচার নিয়ে না। আমি মনে করি এটা মানুষের জীবনের একটা ‘স্ট্র্যাটেজিক চয়েস’-এর ব্যাপার। এতে নিশ্চিতভাবে ভুল বা ঠিক বলে কিছু নেই।
বরং লিখতে বসেছি বাস্তবতার নিরিখে দেখা কিছু পরিবর্তনের ছবি এবং তার পরবর্তী ভাবনা নিয়ে। আমার চারপাশের পরিচিতিদের মধ্যে যারা এখন মাঝবয়সী, তাদের পরিবারের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছেলেমেয়েই বিদেশে পড়ছে, যাদের অনেকেই হয়তো বিদেশেই স্থায়ী হয়ে যাবে। আজকে আমরা যারা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ ভাবনায় নিজেদের ধ্যানজ্ঞান সমর্পণ করে বসে আছি, তারা কী সন্তানদের অনুপস্থিতিতে পরবর্তী জীবন কীভাবে কাটবে তার প্রস্তুতি নিয়েছি?
খুব কাছ থেকে দেখা কিছু অভিজ্ঞতা না বলে পারছি না। আমার মায়ের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন আমি যখন আইসিইউ-এর দরজায় দাঁড়িয়ে পরবর্তী কার্যক্রমের ব্যবস্থা করছি, তখন আমার একমাত্র ভাই বিদেশের মাটিতে তার পরিবারসমেত ইমিগ্রেশন জটিলতার জালে আটকে আছেন।
আমার খুব ঘনিষ্ট এক বন্ধু অসুস্থ মাকে দেখে কানাডায় ফিরে যাবার পথে দুবাই-এর ট্রানজিটে জানতে পারলেন যে তাঁর মা আর নেই। মাঝপথ থেকেই ফ্লাইট বদলে তিনি আবার দেশে ফিরে আসলেন। তবে এর চেয়েও করুণ ঘটনা আমার আরেক পরিচিতের জীবনে ঘটেছিল। দেশ থেকে আমেরিকা যাওয়ার পথে জানলেন তার বাবার অন্তিমযাত্রার কথা। কিন্তু চোখ মুছতে মুছতে আমেরিকা যাওয়ার রূঢ় বাস্তবতার পথটিই তাঁকে বেছে নিতে হয়েছিল। কারণ সেখানে তার চাকরির ভিত তখনও নড়বড়ে। তাই অন্তত চাকরিটা বাঁচুক।
আরো আছে- আমার প্রাক্তন এক সহকর্মী, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। দেশে এসেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী মাকে দেখতে। ফিরে যাবার দুদিন আগে আমার সাথে দেখা। কথাবার্তায় অনুমান করলাম, তাকে দিনদুয়েকের মধ্যে কর্মস্থলে ফিরে যেতে হবে, নয়তো তিনি পুরো পরিবার নিয়ে বিপদে পড়বেন। কাজেই তিনি মনেপ্রাণে চাইছেন, এর ভেতরই তার মায়ের একটা কিছু হোক!
আমি নিজের পরিবারেও কাছাকাছি এরকম ঘটনার মুখেমুখি হয়েছি। আমার ভাই তখন ইরানে চাকরি করেন। ক্যান্সার আক্রান্ত আব্বাকে দেখতে দেশে এসেছেন। ছুটি প্রায় শেষের দিকে। আমার বাস্তববাদী আব্বা গোপনে আমার মাকে ডেকে বললেন, তিনি যেন একমুঠো মাটি এনে আমার ভাইকে দিয়ে ছুঁইয়ে রেখে দেন। যদি আমার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তাঁর মৃত্যু হয় তবে যেন সেই মাটি উনার কবরে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার ভাইয়ের সামনেই আমার আব্বা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
মায়ের শেষ সময়ে তাঁর পাশে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু নিজের মৃত্যুশয্যায় আমার পক্ষে সে ধরনের কিছু প্রত্যাশা করা হয়তো বাস্তবসম্মত হবে না। বিদেশে চাকরি করা আমার ছেলের চাকরির ছুটির তালিকায় মা-বাবার “ফিউনারেল”-এর জন্য সাকুল্যে এক পূর্ণদিবস বরাদ্দ আছে। কাজেই আমি আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছি যাতায়াত করে অযথা সময় নষ্ট না করতে।
কদিন আগে আমার এক বন্ধু তার মা-বাবাকে দেখতে দেশে এসেছিল। তাদেরকে দেখাশোনা করার নির্ভরযোগ্য কাউকে না পেয়ে, আমার কাছে উন্নত মানের “ওল্ড হোম”-এর সন্ধান করছিল। টাকার কোনো অভাব নেই, অভাব নির্ভরযোগ্য মানুষের। প্রয়োজনে এমনকি ডাক্তারের কাছে নেয়ার লোকও নাই। ড্রাইভার কথা শোনে না। গৃহকর্মীদের নিয়ে নীরব আতঙ্ক। পাছে টাকার মোহে বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে যায়!
এমন উদাহরণ রয়েছে ভূরিভূরি।
আজ আমরা যখন সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি, জীবনের সাকুল্য-সঞ্চয় যাদের জন্য বিনিয়োগ করছি, সেই পরবর্তী প্রজন্মের অনুপস্থিতিতে আমরা কী আমাদের শেষ জীবনের জন্য প্রস্তুত হয়েছি? যদি তা না করে সূক্ষ্ম প্রত্যাশা নিয়ে থাকি, তবে বলবো: প্রস্তুত হওয়ার সময় হয়েছে, এখনই।
সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীরও পরিবর্তন দরকার এবং তা হতে হবে সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থাপনার ভেতরেই। বর্তমানে আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছরের উপরে। কাজেই দরকার পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থাপনা। প্রাথমিকভাবে পুরোপুরি পশ্চিমা ধারার ‘ওল্ড হোম’ না হলেও সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য অন্তত ‘স্টুডিও এপার্টমেন্ট’-এর সাথে আনুসাঙ্গিক প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং অন্যান্য সাপোর্ট সার্ভিসের নিশ্চয়তা থাকা জরুরি। এরপর দরকার নিবিড় পরিচর্যার সুব্যবস্থা। পাশাপাশি চিন্তা করা দরকার কীভাবে বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থানের মানুষ এ ধরনের সুবিধাগুলো পেতে পারেন। এসবকিছুর জন্যই একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখার প্রয়োজন।
দুঃখজনক হলেও সত্য- আমরা যারা এখন মধ্যবয়স পার করছি তাদের অনেকেই এখনও বুঝতে পারছি না যে আমাদের কর্মক্ষম থাকার সময় শেষ হয়ে আসছে! সামনের সময়টুকু ভালোভাবে কাটানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে খুব বেশি সময় আর হাতে নেই।
ফেইসবুক কমেন্ট - Facebook Comments